বুধবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২

ঈদ-উল -আযহা। কুরবানী এবং আমাদের দেশের মানুষ।

ঈদ মুবারক,ঈদ মুবারক ঈদ মুবারক হো
রাহেলিল্লাহকে বিলিয়ে দিয়ে কে হলো শহিদ।


ইসলাম এর অনুসারিদের জন্য যে দুটি উৎসব এর দিন নির্ধারিত আছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে ঈদ-উল-আযহা। এই ঈদের অন্যতম অনুসঙ্গ পশু কুরবানি। ঈদ উল আযহার দিন সামর্থবান সকল মুসলিম নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের নামে হালাল পশু কুরবানি করেন। এই কুরবানি কৃত পশুর গোস্ত নিজে পরিবারের সাথে গ্রহন করেন এবং এর একটি বড় অংশ দরিদ্র মানুষদেরকে দেন। এই দান দয়া নয় বরং কুরবানির গোস্তে বঞ্চিতদের অধিকার।

বাংলাদেশে এবং বিশ্বে অনেকেই আছেন যারা এই কুরবানির বিরোধিতা করেন। কারো যুক্তি তথাকথিত পশু অধিকার নিয়ে আর বাংলাদেশে প্রধান যুক্তি অর্থনিতি নিয়ে। বাংলাদেশে প্রধানত যে পশু কুরবানি হয় তা হলো গরু। এই নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেন যে আমাদের কৃষি কাজে যেহেতু গরু ব্যবহত হয় সেহেতু গরু কুরবানি করা কৃষি কাজে উৎপাদনের হার কমিয়ে দেয়। এই যুক্তিটি সম্পুর্ন ভুল। আমাদের দেশে অনেক যায়গায় ১৯৪৭ এর পুর্বে গরু কুরবানি করা যেতনা। অথচ কৃষি গবেষনা কাউন্সিল এর তথ্য অনুযায়ি আমাদের দেশের মোট কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে তার পর থেকে কয়েকশত গুন।

পুষ্টির ক্ষেত্রে আমাদের দেশে প্রোটিন ঘাটতির পরিমান প্রায় ৭৫ শতাংশ। অনেক দরিদ্র আছেন সারা বছরের মধ্যে শুধু এই দিন ভাল ভাবে গোস্ত খেতে পারেন। অনেকে এই সময় যা গোস্ত পান তা দিয়ে পরবর্তি দুই-তিন মাসের গোস্তের চাহিদা পুরন করেন।
ঈদুল আযহা উপলক্ষে দেশের অর্থনিতিতে একটি বিশাল অর্থ সার্কুলেশন হয় যা আমাদের মত একটি দেশের উন্নয়নের জন্য অতি প্রয়োজনিয়। এই কাজটি কিন্তু চলে সারা বছর ধরেই। আমাদের দেশে যে পরিমান গরু কুরবানি হয় তার একটি অংশ ভারত থেকে বৈধ-অবৈধ পথে আমদানি হয়। ছাগল অবশ্য প্রধানত দেশেই উৎপাদিত হয়। এই আমদানির হার আরো বেশি ছিল কিন্তু বর্তমানে গ্রামীন উন্নয়নে গরু মোটাতাজাকরন সহ বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে এই আমদানির হার অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। ঈদ-উল-আযহা এর জন্য পশু পালন গ্রামীন জনগনের জন্য একটি উপযুক্ত কর্মসংস্থান। বিশেষ করে ছাগল পালন এই জন্য গ্রামীন দরিদ্র জনগোষ্ঠির একটি বড় আয়ের উৎস।
ঈদ-উল আযহার জন্য এই পশু কে কুরবানির উপযুক্ত করার জন্য সরাসরি জড়িত থাকে অনেক গুলি পক্ষ যার সকলই কিছু আয়ের সুযোগ হয় এ সময়। আমরা যদি পর্যায় ক্রমে দেখি তা হলে বুঝা যাবে কিভাবে ঈদুল আযহা আমাদের অর্থনিতির উপকার করে।
১.কুরবানির জন্য পশু পালন:- কুরবানির জন্য পুর্নবয়স্ক এবং সুস্থ সবল পশু প্রয়োজন। এজন্য পশু পালনকারী তাকে উপযুক্ত খাদ্য খাওয়ায় এবং নিয়মিত চিকিৎসা করে। এক্ষেত্রে উপকারভোগি পক্ষগুলি হচ্ছে পশুপালনকারী, সহায়তাকারী,পশু ডাক্তার, ওষুধ বিক্রেতা এবং পশুখাদ্য বিক্রেতা।
২.কুরবানির পশু বিক্রয়ের জন্য নিয়ে যাওয়া:- কুরবানীর পশু বিক্রয়ের জন্য উপযুক্ত হাটে নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রাক-ট্রলার ইত্রাদি বাহন ব্যবহার করা হয়। ঢাকা শহরের একটি হাটেই ঈদের ছয়-সাতদিন দিনে গড়ে ১০০ট্রাক কুরবানীর পশু আসে। এক্ষেত্রে উপকারভোগি ট্রাক-ট্রলার চালক,সহকারি,মালিক। উঠানামার কাজে সাহাজ্য কারী শ্রমিক। এবং গ্রাম থেকে পশু ক্রয় করে আনার পাইকার এবং তার সহায়তা কারীরা।
৩.হাটে রাখা :-হাটে পশু রাখতে এবং বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত তার জন্য খাবার-পানি ইত্যাদি প্রয়োজন হয়। এই ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান হয় অনেকের। অন্যদিকে শহরের স্থায়ি-অস্থায়ি হাট থেকে সরকার সরাসরি ইজারা এবং ভ্যাট এর মাধ্যমে রাজস্ব পায়। উপকার ভোগি পক্ষগুলি হচ্ছে হাটের ইজারাদার এবং তার কর্মচারি, হাট সাজানর জন্য উপকরন যথা বাঁশ,শামিয়ানা লাইটিং ইত্যাদি সরবরাহকারী ,হাটে পশুখাদ্য সরবরাহকারী, গোবর সংগ্রহকারী এবং হাট পরিস্কারে নিয়োজিত কর্মচারি,ট্যাক্স ইজারা ও ভ্যাট এর মাধ্যমে সরাসরি সরকার।
৪.বাসায় আনা:- বেশিরভাগ কুরবানী দাতাই ঈদের দুই তিনদিন আগে কুরবানির পশু কিনে নেন। এই দুইতিনদিন পশুদের খাবার স্থানিয় ভাবে সরবরাহ করা হয় এবং দেখাশুনার জন্য লোক নিয়োজিত করা হয়।
৫.কুরবানির প্রস্তুতি:- কুরবানির এবং গোস্ত কাটার জন্য উপযুক্ত ছুড়ি,দা বটি যোগাড় এবং পুরোন গুলি ধার দেওয়া হয়। পশু বাধার জন্য দড়ি এবং গোম্ত কাটার জন্য পাটি ও রাখার জন্য ঝুড়ি ও পাত্র। এক্ষেত্রে সরাসরি উপকার ভোগি এই জিনিস গুলির নির্মাতা ও সরবরাহকারীরা।
৬.কুরবানীর গোস্ত ও চামড়া:- কুরবানির গোস্ত গ্রহনকারী সকল ব্যাক্তি। গোস্ত কাটার জন্য নিয়োজিত পেশাদার ও অপেশাদার কসাই,চামড়া ক্রেতা এবং কোন মাদ্রাসা বা ইয়াতিম খানায় দেয়া চামড়ার উপকারভোগি।
এই্গুলো কুরবানি দেয়ার আগে ও পরের অর্থনিতিতে অবদান ও উকারভোগিদের বিবরন। কুরবানির আরেকটি বড় অবদান হচ্ছে চামড়া শিল্প। বাংলাদেশ বর্তমানে চামড়া শিল্প থেকে বছরে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার আয় করে যার পঞ্চাশভাগ এর বেশি কাজ হয় কুরবানী উপলক্ষে। অনেক ট্যানারি আছে যারা শূধূ এই সময়ই কাজ করে। এই ৫০০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে আমদানির অংশ খুবই কম অর্থাত এই আয় পুরোপুরি মেধের অর্থনিতিতে অবদান রাখে। দেশিয় জুতা ও অন্যান্য শিল্পেও কাচামাল হিসেবে এই চামড়া ব্যবহৃত হয়।

কুরবানির ঈদ বাংলাদেশের অর্থনিতিতে কোন খারাপ প্রভাব তো ফেলেই না বরং এটি দেশের অর্থনিতি এবং কর্মসংস্থান বিশেষ করে গ্রামীন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অনেক বড় অবদান রাখে। যারা কুরবানির বিরোধিতা করেন তারা মূলত অজ্ঞতা এবং অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে করেন। দেশে অনেকই দারিদ্রের জন্য প্রয়োজনিয় প্রোটিন পায়না,সামর্থবান ব্যাক্তিরা এই দিন কুরবানি করেন এবং সেই কুরবানিকৃতপশুতে সামর্থহীনদের যে অংশ থাকে তার মাধ্যমে তারা কিছুদিনে জন্য হলেও প্রোটিন চাহিদা পুরুনের সুযোগ পান।
সুতারং কুরবানি আমাদের মত দেশের জন্য শুধু যুক্তিযুক্তই নয় উন্নয়নের জন্য অতি প্রয়োজনিয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন