বুধবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষন বিমান পিটি-৬।

অন্য একটি ব্লগে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক দুর্ঘটনা সম্পর্কে একটি চমৎকার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। সেটা যারা পড়েছেন তাদের বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষন বিমান পিটি-৬ সম্পর্কে কিছু জানার ইচ্ছা থাকতে পারে। তথ্যগুলি প্রধানত ইন্টারনেট এবং বিমান বাহিনীতে কর্মরত কয়েকজনের সেীজন্যে পাওয়া।

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে ব্যবহত ট্রেনিং বিমান ও হেলিকপ্টার গুলি হচ্ছে।
১. পিটি-৬(সিজে-৬)। প্রাইমারি প্রপেলার ট্রেইনার।
২.টি-৩৭। বেসিক জেট ট্রেইনার।
৩.এল-৩৯। অ্যাডভান্স জেট ট্রেইনার।
৪.বেল-২০৬ হেলিকপটার।

পিটি-৬ বা প্রাইমারি ট্রেইনার-৬ একটি পিস্টন ইঞ্জিন চালিত প্রশিক্ষন বিমান। এই বিমানটি মুলত সোভিয়েট ডিজাইন অনুসারে চিনের তৈরি। চিনা বিমান বাহিনীতে এই বিমান প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৯৬০ সালে। চিনা বিমান বাহিনীতে এটি সিজে-৬ নামে পরিচিত। ১৯৬০ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯৫-২০০০ সাল পর্যন্ত প্রায় পাঁচহাজার সিজে-৬ বিমান তৈরি হয়েছে। তবে অন্যান্য বিমানের তুলনায় এই বিমানটির মডেল আপগ্রেড হয়েছে খুবই কম। তথাপি বিমানের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত সফল প্রশিক্ষন বিমান হিসেবে এই বিমানটি অনেক উপরে স্থান করে নিয়েছে। চিনা বিমান বাহিনী ছিল এর প্রথম থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত প্রধান ব্যবহারকারী। ১৯৬৫ সালে চিন এই বিমানের একটি মডেল সিজে-৬ এ তৈরি করে। এই মডেলটি বিদেশে রপ্তানী করা হয় পিটি-৬ ও পিটি-৬ এ নামে। তৎকালিন সময়ে উন্নত টেকনলজি এবং সল্প মুল্য ও উড্ডয়ন ব্যায় এবং সহজ রক্ষনাবেক্ষনের সুবিধার জন্য এই বিমানটি খুব দ্রুতই জনপ্রিয় হয়। চিনের পর মধ্যপ্রাচ্য,উত্তর কোরিয়া, আফ্রিকা ও পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি বিমান বাহিনী তাদের প্রধান প্রশিক্ষন বিমান হিসেবে এই বিমানটিকে গ্রহন করে। তবে বর্তমানে চিন ছাড়া আর যে কয়েকটি দেশ এই বিমানটি ব্যবহার করছে সেগুলি হচ্ছে বাংলাদেশ,আলবেনিয়া,উত্তর কোরিয়া,ইকুয়েডর,শ্রীলংকা এবং লাওস।

পিটি-৬ একটিএক ইঞ্জিনের দুই আসন বিশিষ্ট বিমান। বৈমানিক এর আসন বা ককপিট দুটি ট্যানডেম বা একটির পিছনে একটি ভাবে থাকে। উভয় ককপিট থেকেই বিমানটির পুর্ন নিয়ন্ত্রন করা যায়। সাধারনত সামনের দিকের ককপিটে প্রশিক্ষনার্থি এবং পিছনের দিকের ককপিটে প্রশিক্ষক বসেন। এটি মাত্র ২৮ফুট লম্বা এবং এর উইং স্প্যান বা ডানার মোট দৈর্ঘ ৩৩ফুট ৬ ইঞ্চি। সর্বোচ্চ গতি ১৬০ নটিক্যাল মাইল প্রতি ঘন্টায়। এর একটি ইঞ্জিন ও প্রপেলার সামনের দিকে অবস্থিত। সাধারনভাবে কোন অস্ত্র বহন করেনা তবে মেশিনগান ও বোমা বহন করতে পারে। প্রশিক্ষন ছাড়াও পর্যবেক্ষন,এরিয়াল ফোটগ্রাফি ও এরোবেটিকস বা বিমান নিয়ে বিভিন্ন কৈীশল প্রদর্শনের জন্যও এই বিমানটি ব্যবহত হয়। পিটি-৬ বিমান তৈরি হয় প্রধানত চিনের নানচাং এয়ারক্রাফট ম্যানুফ্যাকচারিং ফ্যাক্টরীতে। তবে লাইসেন্স নিয়ে আরো কয়েকটি দেশ এটি উৎপাদন করত। পিটি-৬ বিমান হিসেবে খুবই হালকা এবং ম্যানুয়ালি একে পরিচালনা করতে হয়। রেডিও ছাড়া আর কোন বিশেষ উল্লেখযোগ্য ইলেকট্রনিক যন্ত্র এতে নাই। এই বিমানটি সাধারনত ২৮৫ অশ্বশক্তির একটি পিষ্টন ইঞ্জিন ব্যবহার করে। এখানে উল্লেখ যোগ্য বর্তমানে প্রপেলার চালিত বিমানের জন্য ব্যবহত হয় টারবাইন ইঞ্জিন। পিষ্টন ইঞ্জিন এখন বিমান এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও খুব কমই ব্যবহত হয়।
আধুনিক না হলেও প্রাথমিক প্রশিক্ষনের জন্য এটি একটি উপযুক্ত বিমান।

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে প্রথম এই বিমান যুক্ত হয় ১৯৭৭ সালে। যশোরে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ বিমান বাহিনী একাডেমিতে এই বিমান ব্যবহার করা হচ্ছে আজ পর্যণ্ত। বর্তমানে প্রায় ৩০-৪০ টি পিটি-৬ বিমান রয়েছে। এই বিমানগুলি ১১ স্কোয়াড্রনের আওতা ভুক্ত। যশোরের বিমান বাহিনী একাডেমি ছাড়াও বগুড়ায় অবস্থিত ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর ট্রেনিং স্কুল ও এই বিমান ব্যবহার করে থাকে। এই বিমানগুলি ১৯৭৭-১৯৯২ সালের মধ্যে আমদানি করা হয়েছে। অর্থ্াত এই বিমানগুলি কম পক্ষে আঠারো বছরের পুরনো। তবে নিয়মিত ওভারহল করা হলে একটি বিমান ৪০-৫০ বছর পর্যন্ত কার্যকর থাকতে পারে। পিটি-৬ এর ক্ষেত্রে ওভার হলিং সময় হচ্ছে একহাজার উড্ডয়ন ঘন্টা। অর্থাত প্রতি একহাজার ঘন্টা উড্ডয়নের পর এই বিমান গুলি ওভারহলিং এবং কিছু যন্ত্রাংশ পরিবর্তনের দরকার হয়। প্রশিক্ষন কাজে নিয়োজিত থাকায় এই বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর এই বিমানগুলি সবচেয়ে বেশি সময় উড্ডয়ন করে। ওভার হলিং এর জন্য চিনে পাঠাতে এক সময় প্রচুর অর্থ ব্যায় ও সময় নষ্ট হতো । নব্বই এর দশকে এই বিমানগুলি দেশেই ওভারহল করার ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিস্তু দেশের সর্বগ্রাসী দুর্নিতী এই ক্ষেত্রেও প্রবেশকরে। এই বিমানগুলি ওভারহল করার সময় মানসম্পন্ন যন্ত্রাংশ দ্বারা রিপ্লেসমেন্ট না করার অভিযোগ উঠে। পাশাপালি চিন এই বিমানের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়ায় প্রয়োজনিয় যন্ত্রাংশের অভাবও দেখা দেয়। এমতবস্থায় এই বিমানগুলি চলাচল ঝুঁকি পুর্ন হয়ে যায়। গত কয়েক বছরে এই বিমানগুলিতে বেশকয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে।
পিটি-৬ বিমানগুলির পরিবর্তে নতুন আধুনিক প্রাইমারি ট্রেইনার ক্রয় করার জন্য ১৯৯০ সাল থেকেই আলোচনা হচ্ছে। জেনস ডিফেন্স উইকলি সহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী পাকিস্তান হতে "এমএফআই-১৭ মুশশাক" বিমান সংগ্রহ করতে যাচ্ছে বলে জানা যায় ২০০০ সালের দিকে। কিন্তু এটি মান সম্পন্ন নয় বলে এই প্রষ্তাব বাতিল করা হয়। যদিও এই বিমানটি এবং এর আপগ্রেডেড ভার্সন "সুপার মুশশাক" পাকিস্তান,সৈীদি আরব সহ বেশ কয়েকটি দেশে ব্যবহত হচ্ছে। এই বিমানটি মুলত সুইডেন কর্তক ডিজাইন করা "সাব সাফারী" বিমানের লাইসেন্সড কপি। সুইডেন কতৃক নির্মিত বিমান কয়েকটি ইউরোপিয় বিমান বাহিনীতে ব্যবহত হচ্ছে। তথাপি কোন কারনে এই বিমানটি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়নি। এ অবস্থায় ইউরোপিয় বা মার্কিন মডেলের বিমান সংগ্রহের চেষ্টা নেয়া হলে ও উচ্চ মুল্য সহ বিভিন্ন কারনে তা এখনও সম্ভব হয়নি।
পিটি-৬ বিমান চিনা বিমান বাহিনী ২০১১ সালের মধ্যেই বাতিল করে দিচ্ছে। তার পরিবর্তে আধুনিক পিটি-৭ বিমান সংযোজিত হচ্ছে তাদের বিমান বাহিনীতে। অন্যদিকে সময়মত নতুন বিমান ক্রয় না করায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে ঝুঁকিপুর্ন এই বিমান ব্যবহার করে তাদের অতি গুরুত্বপুর্ন প্রশিক্ষন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে। আরো কোন মায়ের কোল খালি হওয়ার আগেই সরকার এই বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহন করবেন এটিই আমাদের কামনা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন