সোমবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১২

র‌্যাগিং ! জীবনের বাস্তবতার শিক্ষা না অপসংস্কৃতি।

র‌্যাগিং নামক অপসংস্কৃতি বর্তমানে আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ছড়িয়ে পড়েছে প্লেগের মত। যদিও র‌্যাগিং একেবারে নতুন কিছূ নয় এবং অনেক প্রতিষ্ঠানে তা অনেকদিন ধরেই প্রচলিত। কিন্তু বর্তমানে র‌্যাগিং যে রুপ ধারন করেছে তা একান্তই অশ্লিল এবং অত্যাচার মাত্র। বুয়েট,জাহাঙ্গিরনগর এই দুটি বিশ্ব বিদ্যালয়ে র‌্যাগিং এর কথা অনেক আগে থেকে শোনা গেলেও ঢাকা বা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা কলেজ,জগন্নাথ কলেজ বা চট্টগ্রাম কলেজ এর মত প্রতিষ্ঠানগুলিতে র‌্যাগিং এর উপস্থিতি ছিল খুবই কম ফলে তা কারো দৃষ্টি আকর্ষন করতোনা। কিন্তু বর্তমানে প্রায় সকল সরকারী এবং বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে হাই স্কুলে ও র‌্যাগিং এর নামে যথেচ্ছ আচরনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। আগেও অনেকে র‌্যাগিং এর শিকার হলেও তা হতো অনেকটাই দলগত পর্যায়ে এবং তা শারিরিক বা মানসিক বেশি ক্ষতিকর হতোনা বিধায় র‌্যাগিং এর শিকার হলেও তা নিয়ে বেশি আলোচনা কেউ করতোনা। কিন্তু বর্তমানে তা অতিরিক্ত ক্ষতিকর পর্যায়ে চলে গেছে। র‌্যাগিং এর শিকার হয়ে আত্মহত্যা করার এবং স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার ও সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে।

র‌্যাগিং পৃথিবীর সবদেশেই কমবেশি প্রচলিত। উত্তর আমেরিকায় এটি প্রচলিত হেজিং বলে। বৃটিশ পাবলিক স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এক সময় এটি প্রায় রিচুয়্যাল বা ধর্মিয় অনুষ্ঠানের মতই ছিল। তবে বর্তমানে উন্নত বিশ্বে র‌্যাগিং কে কঠোর ভােবই নিয়ন্ত্রন করা হচ্ছে। র‌্যাগিং এর শুরুর ইতিহাস পাওয়া যায় খৃষ্টপুর্ব ৮০০ সনের থেকে যখন গ্রীসের অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করতে আসা নতুন প্রতিযোগিদের কে নানা ভাবে উত্তক্ত করা হত যাতে তারা পুরনো প্রতিযোগিদের হারাতে না পারে। এরপর বিভিন্ন দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও এর প্রচলন হয়। বিশেষ করে বৃটিশ অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাবলিক কলেজগুলিতে র‌্যাগিং কে অতিপ্রয়োজনিয় বলে মনে করা শুরু হয়। নতুন আসা এক তরুন ছাত্রকে তার কৈশোরের রোমান্টিক সপ্নকে ভুলিয়ে বাস্তব জীবনের সাথে পরিচিত করানর পদ্ধতি হিসেবেই র‌্যাগিং কে গ্রহন করা হয়। সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের পদ্ধতি ও শৃঙ্খলার সাথে একিভুত করাও ছিল এর উদ্যেশ্য। তখন র‌্যাগিং টি ছিল কেীতুক করা বা শারিরিক পরিশ্রম করানো মাত্র। অত্যাচারের পর্যায়ে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে। যুদ্ধ ফেরত বয়স্ক ছাত্ররা যুদ্ধের সময় যে ভয়ংকর আচরন দেখেছিল তা অন্যদের উপর প্রয়োগ করা শুরু করে। এভাবে র‌্যাগিং ভয়ংকর একটি বিষয়ে পরিনিত হয়। র‌্যাগিং একটি সাধারন শৃঙ্খলা শেখানোর পদ্ধতি থেকে হয়ে যায় অত্যাচারের সুযোগ এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার পদ্ধতি হিসেবে। উপমহাদেশে র‌্যাগিং এর প্রচলন হয় প্রধানত অভিজাত ইংরেজি স্কুলগুলিতে। এসব প্রতিষ্ঠান মুলত বৃটিশ পাবলিক স্কুলের ধারায় এই সংস্কৃতির প্রচলন করে। এক পর্যায়ে এটিও অত্যাচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয়। তবে উপমহাদেশে বিশ্ব বিদ্যালয় পর্যায়ে র‌্যাগিং শুরু হয় ষাটের দশকে। এর পর আশির দশকের শেষ দিকে তা ভারত ও শ্রীলংকায় ভয়ংকর রুপ ধারন করে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানেও এর প্রচলন তখনই হয়। এবং এটি বৃদ্ধি পেয়ে এখন একটি ভয়ংকর ব্যাধিতে পরিনিত হয়েছে।
বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে র‌্যাগিং এর প্রবনতা বৃদ্ধি পায় নব্বই এর দশকে। যদিও বিভিন্ন সুত্র মতে জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েটে আগে থেকেই বেশ ভয়ংকর র‌্যাগিং ছিল। আমাদের দেশে র‌্যাগিং এর সৃষ্টি প্রধানত ভারতিয় বিশ্ববিদ্যালগুলিকে অনুকরন করতে গিয়ে। ভারতে একসময় র‌্যাগিং এমন ভয়ংকর ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল এক বছরে প্রায় ৩০ টি মৃত্য ও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটতে শুরু করেছিল শুধু র‌্যাগিং এর কারনে। যার কারনে ভারতিয় সুপ্রীম কোর্ট র‌্যাগিং সম্পর্কে তদন্তের জন্য গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই এর সাবেক পরিচালকের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করার আদেশ দেয়। এছাড়াও কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষগুলিকে র‌্যাগিং বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয়। এতে করে র‌্যাগিং কমে আসলেও সর্বশেষ ভারতের বিভিন্ন যায়গায় র‌্যাগিং এর কারনে ২০০৯ সালে কমপক্ষে সাত জনের মৃত্য ও আত্মহত্যার খবর জানা গেছে। ভারতের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত বন্ধু বান্ধবদের কাছে শুনে এবং স্যাটেলাইট টেলিভিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশে র‌্যাগিং পরিচিত হয়ে উঠে। জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানিক কান্ড এর রিপোর্ট মিডিয়ায় আসার পরই র‌্যাগিং সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য মানুষ জানতে পারে। আগে উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানগুলি ছাড়াও বাংলাদেশে মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ি শাহজালাল এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিংএর প্রবনতা ছিল। তবে এখন এটি ঢাকা ,চট্টগ্রাম বা রাজশাহির মত পুরোন বিশ্ববিদ্যালয়েও ছড়িয়ে পড়েছে। র‌্যাগিং এর নামে নতুন ছাত্র-ছাত্রি কে সিগারেট টানতে বাধ্য করা , ছেলে মেয়ে হাত ধরা বা জোড় করে আলিঙ্গন করতে বাধ্য করার মত ঘটনাতো সাধারন হয়ে গেছে। দোতলা থেকে লাফদিতে বাধ্য করার মত নিষ্ঠুরতাও র‌্যাগিং এর নামে করা হয়। আর র‌্যাগিং এর নামে সবচেয়ে বেশি যে অপরাধটি করা হয় তা হচ্ছে যেীন হয়রানি। ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে এই হয়রানির শিকার হয়। বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশে বর্তমানে র‌্যাগিং এর নামে মুলত যেীন হয়রানিই করা হয় এবং নৈতিকতার পতনের কারনে এজন্যই র‌্যাগিং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

র‌্যাগিং এর পক্ষে কয়েকটি মিথ গড়ে উঠেছে এগুলি হচ্ছে।

১.র‌্যাগিং একজন নবিন ছাত্রকে শক্ত ও আত্মবিশ্বাসি করে তোলে।
প্রকৃত সত্য হচ্ছে র‌্যাগিং একজন অনভিজ্ঞ ছাত্রকে ভিতু ও হীনমন্য করে তোলে।

২.র‌্যাগিং নতুন ও পুরাতনের মধ্যে সেতু বন্ধন তৈরি করে।
প্রকৃত সত্য হচ্ছে এখানে নতুন রা পুরাতনদের অত্যাচারি ও অভদ্র হিসেবে দেখে ফলে তাদের মনে ঘৃনা সৃষ্টি হয়।

৩.র‌্যাগিং নতুনদের মধ্যে শৃঙ্খলা এবং একতাবোধ তৈরি করে ও প্রতিষ্ঠানের নিয়মাবলির মেনে চলার মানসিকতা তৈরি করে।
প্রকৃত সত্য এই র‌্যাগিং অন্যদের প্রতি ঘৃনা ও অবজ্ঞার সৃষ্টি করে এবং অমানবিক এই আচরনের শিকারদের মধ্যে সেই প্রতিষ্ঠানের নিয়মাবলির প্রতি অশ্রদ্ধার সৃষ্টি করে যা তাকে যন্ত্রনা দিয়েছে এবং এর ফলে সে অবচেতন ভাবেই প্রতিষ্ঠানের নিয়মাবলির ভাংতে উৎসাহিত হয়। আর একতার নামে সৃষ্টি করে মব মাইন্ড অর্থাত দলবদ্ধ হয়ে ক্ষতিকর কাজে লিপ্ত হওয়ার প্রবনতা।

৪. র‌্যাগিং এর মাধ্যমে নতুনদের জীবনের বাস্তব অবস্থার সাথে পরিচিত হতে সাহাজ্য করে।
প্রকৃত সত্য এই বৃটিশ পাবরিক স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে অভিজাত ঘরের সন্তানেরা পড়তে আসত তারা বাস্তব পৃথিবী সম্পকেৃ খুব কমই ধারনা রাখত তাদের জন্য এটি সঠিক হলেও বর্তমান বাংলাদেশের যেখানে অসংখ্য মেধাবী ছাত্র নিজের পড়ার খরচ যোগায় টিউশনি করে বা কাজ করে তারা জীবন সম্পর্কে যথেষ্টই জানে।

৫. র‌্যাগিং বড়দের সন্মান ও শ্রদ্ধা করতে শেখায়।
এটি সম্পুর্ন মিথ্যা। সাংস্কৃতিক পরিবেশ ও পারিবারিক শিক্ষার ফলে আমাদের দেশে এমনিই একজন বড়ভাই এর প্রতি শ্রদ্ধার আভাব থাকেনা। র‌্যাগিং বরঞ্চ সিনিয়রদের প্রতি ঘৃনার সৃষ্টি করে। জুনিয়ররা যেখানে এমনিতেই সিনিয়রদেরকে সন্ম,ান করে তাদের নির্দেশ পালন করে সেখানে তাদের এই শ্রদ্ধার সুযোগ নিয়ে তাদেও উপর অত্যাচার চালানো হয়। এই অত্যাচার তাদের মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এক সময় তারাও তাদের জুনিয়র দের উপর অত্যাচার চালানোকে স্বাভাবিক বলে মনে করে। এই প্রবনতা অনেকের পেশাগত জীবনেও চলে আসে যার ফলে উর্ধতনদের কাছে কেঁচো হয়ে থাকলেও তারা অধঃস্থনদের জন্য অত্যাচারি বাঘের রুপ ধারন করে।

র‌্যাগিং বৃদ্ধি পাওয়ার প্রধান কারনগুরি হচ্ছে
১.অপসংস্কৃতির প্রাদুর্ভাব।
২.জোড় করে কতৃত্ব নেওয়ার মানসিকতার বৃদ্ধি।
৩.দুর্বলের প্রতি অত্যাচার করার সহজ সুযোগ।
৪.নিজে র‌্যাগিং এর শিকার হওয়ার কারনে র‌্যাগিং কে অধিকার বলে মনে করা।
৫.বড়দের প্রতি স্বাভাবিক শ্রদ্ধার কারনে এবং ভয়ে র‌্যাগিং এর প্রতিবাদ না করা।
৬.র‌্যাগিং কারি রা পরবর্তিতে সাহাজ্য করবে এই ধারনা রাখা। আমাদের মুখস্ত করা ও নোট নির্ভর পড়াশুনার সংস্কৃতিতে সিনিয়রদের থেকে নোট পাওয়া অত্যন্ত জরুরী বলে মনে করা হয়। ফলে র‌্যাগিং এর শিকার হলেও এর প্রতিবাদ না করা।

র‌্যাগিং এর শুরুর পিছনে যে উদ্দ্যেশ্যই থাকুকনা কেন বর্তমানে র‌্যাগিং শুধু প্রধানত যেীন হয়রানির সুযোগ এ পরিনত হয়েছে। অন্যদিকে নতুন ছাত্র-ছাত্রি যারা নতুন পরিবেশে একটু সহানুভুতি ও সহায়তার প্রত্যাশা করে তাদেরকে ভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে করে তোলে মানসিক ভাবে অসুস্থ। তার মধ্যে তৈরি করছে ঘৃনার অনুভুতি এবং জ্বালিয়ে তুলছে প্রতিশোধের আগুন। এই আগুন নিভাতে অক্ষম হয়ে সে আবার তার জুনিয়রদের উপর অত্যাচার চালিয়ে তৃ্িপ্ত লাভ করার চেষ্টা করছে। র‌্যাগিং অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রির মেধাবিকাশের পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে । একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এখানে বলা যায়। আমার একজন আত্মিয়া চট্টগ্রাম বোর্ড থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি ও এইচএসসি জিপিএ ৫ সহকারে উর্ত্তিন হয়ে একটি বিভাগিয় শহরে এক মহান বীর ও মানবপ্রেমির সাধকের নামাংকিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল নিজের সবচেয়ে পছন্দনিয় বিষয়ে। আমি নিজেও তখন কর্মসুত্রে সেই শহরে ছিলাম। মাস ছয়েক পর একদিন সে আমাকে টেলিফোনে জানায় যে সে বাড়িতে চলে যাচ্ছে এবং সে আর লেখাপড়াই করবেনা। আমি তখন তার কাছ থেকে কিছু জানতে না পারলেও পরে জানতে পাড়ি ক্লাসে ও হোষ্টেলে র‌্যাগিং এর শিকার হয়ে সে ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়। প্রায় এক বছর সে লেখা পড়া করেনি। পরে একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ উত্তির্ন হয়ে বর্তমানে একটি গ্রুপ অফ কোম্পানি তে কর্মরত আছে। র‌্যাগিং এভাবে কত মেধাবী শিক্ষার্থির জীবন চিরতরে ধ্বংস করে দিয়েছে তার হিসাব নেই। এই ভয়ংকর ও সমাজ বিরোধি অপস্স্কংৃতির আশু সমাপ্তি হওয়া প্রয়োজন।

র‌্যাগিং প্রতিরোধে করনিয়
১.নিজে র‌্যাগিং এর শিকার হয়ে থাকলেও জুনিয়রদের প্রতি প্রতিশোধ নেয়া থেকে বিরত থাকুন এবং বন্ধুবান্ধবদের বিরত রাখুন।
২. নিজের ছোট ভাই বোন দের প্রতি লক্ষ রাখুন তারা যেন র‌্যাগিং না করে এবং র‌্যাগিং এর শিকার না হয়।
৩. র‌্যাগিং এর শিকারদের ”ইউনিভার্সিটিতে এরকম হয়, ওটা কিছুনা”। ”বড় ভাইবোনরা এরকম করেই” । ”যাই করুক বড়দের তো সন্মান করতে হবে” এই জাতিয় কথায় না ভুলিয়ে প্রতিবাদ করার সাহস দিন। অন্তত পক্ষে তার প্রতি সহানুভুতি প্রকাশ করুন এবং অত্যাচারিকে অত্যাচারি বলে রায়দিন।

সকলের যেীথ উদ্যোগ র‌্যগিংকে প্রতিরোধ করবে ইনশাআল্লাহ।

1 টি মন্তব্য: