বুধবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২

এই পৃথিবী একবার পায় তারে। সৈয়দ আলি আহসান।

আজকে ২৫ জুলাই কবি,প্রাবন্ধিক,শিক্ষাবিদ,গবেষক,সাহিত্যিক,জাতিয় অধ্যাপক সর্বোপরি আমাদের জাতিয় জিবনের অভিভাবক সৈয়দ আলি আহসান এর নবম মৃত্যুবার্ষিকী। নয়টি বছর তার ইন্তেকালের পর পার হয়ে গেছে কিন্তু তার অভাব এখনও কোন অংশেই পুরন হয়নি। আর বর্তমান সময়ে তার অভাব আমরা অনুভব করছি আরো বেশি।
মরহুম আবুল মনসুর আহমদ মাওলানা আকরাম খানের ইন্তেকালে লিখেছিলেন,”দেশ হারাইল একটি আলোক স্তম্ভ,দেশবাসি হারাইল বাড়ীর মুরুব্বি,সাহিত্যিক সাংবাদিকরা হারাইলেন উপদেষ্টা,রাজনিতিবিদরা হারাইলেন পথের দিশারি,আলেম সম্প্রদায় হারাইলেন একজন অনুপ্রেরনা দাতা”,ঠিক এই কথাগুলি প্রযোজ্য সৈয়দ আলি আহসানের জন্যও। তিনি ইন্তেকাল করেছেন তিরাশি বছর বয়সে। আমাদের গড় আয়ুর হিসেবে দির্ঘ জিবনের অধিকারি হয়েছিলেন। আর এই দির্ঘ জিবনে তিনি এই বাংলাদেশ ও জাতি এবং মানবতার জন্যই কাজ করে গেছেন। বহুমুখি এই প্রতিভা তার মৃত্যর দিন পর্যন্ত কাজ করেঘেছেন,লিখে গেছেন অসংখ্য গবেষনা,প্রবন্ধ,গল্প,উপন্যাস,স্মৃতি কথা এবং অবশ্যই কবিতা। নিজেকে তিনি কবি বলেই পরিচয় দিতেন প্রায়ই যদিও তার প্রধান খ্যাতি ছিল শিক্ষাবিদ হিসেবেই।
সৈয়দ আলি আহসানের জন্ম ১৯২২ সালে ২৬ শে মার্চ মাগুরা জেলার আলোকদিয়া গ্রামে। এই ক্ষেত্রে তার সাথে তার একজন প্রিয় সাহিত্যিক ও বন্ধু ভারতিয় লেখক খুশবন্ত সিং এর মিল আছে। উভয়ের জন্মদিনই পরবর্তিতে স্ব স্ব দেশের স্বাধিনতা দিবসে পরিনিত হয়। গ্রামে তার পড়াশোনার শুরু হয়। পরবর্তিতে তার শিক্ষাবিভাগের কর্মরত পিতার সাথে ঢাকায় স্থায়ি ভাবে চলে আসেন এংব আর্মানিটোলা স্কুলে ভর্তি হন। তিনি তার পরিবারের জেষ্ঠো পুত্র। আর্মানিটোলা স্কুল থেকে,মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরিক্ষায় উত্তির্ন হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন তিনি এবং এখান থেকে ১৯৪৪ সালে মাষ্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি এরপর প্রথমে যোগ দেন তৎকালনি অলইন্ডিয়া রেডিওতে। রেডিওর প্রোগ্রাম এসিষ্টেন্ট হিসেবে যোগ দেন কলকাতা কেন্দ্রে।তবে এর আগে তিনি সল্প সময় হুগলি কলেজে অধ্যাপনা করেছিলেন। রেডিওতে তার যোগদানের পর তখন রেডিওতে কর্মরত তার সহকর্মি সাহিত্যিক,অভিনেতা ও চলচ্চিত্র পরিচালক নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ চট্যোপাধ্যায় এর সহযোগিতায় তিনি তৎকালিন রেডিওতে অবহেলিত মুসলিম বুদ্ধিজিবি এবং শিল্পিদেরকে অনুষ্ঠানের সুযোগ করে দেন। যা রেডিওতে কর্মরত অনেকের কায়েমি স্বার্থকে ক্ষুন্ন করে। তাকে অল ইন্ডিয়া রেডিওর ঢাকা কেন্দ্রে বদলি করা হয়। ১৯৪৭ স্বাধিন হয় পাকিস্তান। ১৯৪৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ইংরেজি বিভাগের ছাত্র হলেও বাংলা সাহিত্য ও কবিতায় ততদিনে তার খ্যাতি বিস্তৃত হওয়ায় তিনি এই সুযোগ পান। তিনি লেখালেখি ও কবিতা রচনা শুরু করেছিলেন তার স্কুল জিবনেই। তবে কলকাতায় অবস্থান কালেই সাহিত্যিক হিসেবে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন। ১৯৫৩ সালে তিনি করাচি বিশ্ববিদ্যারয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। এখানে কর্মরত থাকার সময় তিনি বাংলা ভাষা সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে পরিচিত করে তুলার জন্য অনেক অবদান রাখেন। ১৯৬০ সালে তিনি বাংলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে দ্বায়িত্ব গ্রহন করেন। তার সময়ে বাংলা একাডেমি অত্যন্ত গতিশিল একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠে । কিন্তু তার স্বাধিনচেতা মানসিকতার কারনে তৎকালিন গভর্নর মুনায়েম খানের সাথে তার সংঘাতের সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত তাকে বাংলা একাডেমি ত্যাগ করতে হয়। তিনি এরপর অধ্যাপক হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগদেন। তার সাহিত্য ও পারিবারিক জিবনে এই সময়টি বিশেষ উল্লেখযোগ্য বলে তিনি বিভিন্ন লেখায় উল্লেখ করেছেন। এই সময় পাকিস্তান রাষ্ট্রটির উপর তিনি আস্থা হারিয়ে ফেলেন। ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ এর পর তিনি এপ্রিল মাসের প্রথমেই রামগড় দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে বেতার সম্প্রচার এবং বিশ্বের সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজিবি অঙ্গনে বাংলাদেশের স্বাধিনতার প্রতি সমর্থন অর্জনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। ১৯৭২ সালে তাকে জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত করা হয়।নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয় টি গড়ে তুলতে তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তার ব্যাক্তিত্ব তাকে আবারও সরকারের কর্তাব্যাক্তিদের বিরাগ ভাজন করে তুলে। সরকারি দল এবং এর ছাত্র সংগঠনের কাছে আত্মসমর্পন না করার অনমনিয়তার জন্য তিনি তাদের চক্ষুশুল হয়ে উঠেন। শেষ পর্যন্ত তাকে পদত্যাগ করতে হয়। তৎকালিন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমান তার প্রতি শ্রদ্ধা সত্বেয় তাকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেন। এর পর তিনি আবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যায়ে যোগ দেন ।১৯৭৫ সালের শেষ দিকে তিনি রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। ১৯৭৭ সালে পুর্ন মন্ত্রির পদমর্যাদায় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা হিসেবে যোগদেন। তার দায়িত্ব ছিল শিক্ষা,ক্রিড়া,সংস্কৃতি ও ধর্ম বিভাগের। এই পদে থেকে তিনি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তনের উদ্যোগ নেন এবং অনেক কাজ সম্পন্ন করতেও সক্ষম হন। এর মধ্যে দেশের কারিগরি শিক্ষা ও পলিটেকনিক ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গুলির উন্নয়নে তার অবদান বিশেষ উল্লেখযোগ্য । দেশের ক্রিড়ার উন্নয়নে ও তিনি অনেক কাজ করেন। এসময় ই বাংলাদেশ আইসিসির সহযোগি সদস্য পদ লাভ করে এবং বক্সার মুহাম্মদ আলি বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার এই বহুমুখি কর্মকান্ড আবার কায়েমি স্বার্থবাদি শক্তির জন্য বিপদ হয়ে দেখা দেয় এবং শেষ পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব থেকে সরে আসেন। এরপর দির্ঘদিন তিনি কোন নিয়মিত কাজ করেননি। মাঝখানে কিছুদিন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। ১৯৮৯ সালে তিনি জাতিয় অধ্যাপক হন। শেষ বয়সে তার ছোটভাই সৈয়দ আলি আশরাফ প্রতিষ্ঠিত দারুল এহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন।
সৈয়দ আলি আহসান তার দির্ঘ জিবনে আমাদের দেশ ও জাতির জন্য অনেক কাজ করে গেছেন। জিবনের শেষ দিনগুলিতেও তার লেখার বিরাম ছিলনা। অসংখ্য প্রবন্ধ ও স্মৃতিকথায় তিনি সম্বৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যকে। আর কবি হিসেবে তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন নতুন দিগন্তের সৃষ্টি কারি ।
২০০২ সালের ২৫ শে জুলাই তিনি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন।

আজকে তার নবম মৃত্য বার্ষিকিতে দেশের পত্রিকা ও ব্লগের নিরবতা দেখে ভাবছি এই দেশে কি তার মতো আর কেউ জন্ম গ্রহন করবে কিনা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন