বুধবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২

ব্ল্যাক সানডে থেকে ব্ল্যাকহোল মানডে।

পশ্চিম ইউরোপিয় সংস্কৃতিতে মাসের তের তারিখ শুক্রবার পড়াকে খুব অশুভ বলে গন্য করা হয়। এই রকম দিন কে বলা হয় ব্ল্যাক ফ্রাইডে। এর উৎস সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ আছে। যেমন কেউ বলেন এই দিনেই যিশুখ্রিষ্টকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল তাই এই দিন অশুভ আবার কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে এই দিন টেম্পলার নাইট দের বিরুদ্ধে সারা ইউরোপ ব্যাপি অভিযান পরিচালিত হয়েছিল। যদিও এই দিনটি সম্পর্কে অশুভ মনে করার বিশ্বাস খৃষ্টপুর্ব সময় থেকে চলে আসছে বলে বেশিরভাগ পন্ডিত ব্যাক্তিই একমত।
অর্থনিতির ক্ষেত্রে ১৯২৯ সালের অক্টোবর মাসে নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেন্জ এর বিশাল দর পতন কে বলা হয় ব্ল্যাক ফ্রাইডে। এই দরপতন এর দিন থেকেই শুরু হয় দি গ্রেট ডিপ্রেশন বা বিশ্বব্যাপি অর্থনৈতিক মন্দা যা স্থায়ি হয় দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত। ২৯ শে অক্টোবর ১৯২৯ সাল ছিল প্রকৃত পক্ষে বৃহস্পতি বার। তবে তখন এত দ্রুত তথ্য পরিবহনের ব্যবস্থা ছিলনা বিধায় এই বিশাল দর পতনের খবর সবখানে পেীছতে সময় লেগে যায় যার কারনে এবং এই দর পতনের ভয়াবহতার জন্য এদিনটি ব্ল্যাক ফ্রাইডে বলে পরিচিত হয়ে উঠে।

গতকাল ৯ই জানুয়ারি,২০১১ রবিবার কে দৈনিক নয়াদিগন্ত শিরোনাম করেছে পুজিবাজারের ব্ল্যাক সানডে হিসেবে। কারন সারা দিনের ট্রেড শেষে মুল্য সুচক বা ইনডেক্স কমেছে দেশের উভয় স্টক এক্সচেন্জ এ ছয় শত পয়েন্ট এরও বেশি। যা শতকরা হিসেবে যথাক্রমে ৭.৭৫ ও ৬.৩৪ শতাংশ ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেন্জে এ। গতকাল বাজার প্রথম একঘন্টায় পড়ে প্রায় ২০০ পয়েন্ট। মাঝখানে সাময়িকভাবে উর্ধগামি হলেও দিনের শেষে এই মুল্য কমে যায়। আর আজকে ১০ই জানুয়ারি,২০১১ সোমবার লেনদেন শুরুর প্রথম একঘন্টার মধ্যেই ঢাকা স্টক এক্সচেন্জ এর সূচক কমে যায় ছয়শ পয়েন্ট এরও বেশি। এ অবস্থায় উভয় স্টক এক্সচেন্জ এর লেনদেন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।
আমাদের শেয়ার বাজারের পরিস্থিতিতে এই দরপতন অপ্রত্যাশিত না হলেও এতটা দরপতন খুবই অস্বাভাবিক। শেয়ার বাজারের বিশেষজ্ঞগন প্রায় ছয়মাস ধরে বলে আসছিলেন এই দর পতনের আশংকার কথা বলে আসছিলেন। বিভিন্ন কারনে দেশে শিল্প বিনিয়োগে স্থুবিরতা এবং ব্যবসায় মন্দা মানুষকে নিয়ে আসছিল শেয়ার বাজারে। এই কারনে আমাদের শেয়ার বাজারগুলিতে বাজার মূলধন বেড়ে যায় অস্বাভাবিকভাবে অন্যদিকে ভাল শেয়ারের সরবরাহ ছিল কম। বিনিয়োগে স্থবিরতার জন্য ব্যাংকগুলি তাদের আমানতের বিশাল অংশ বিনিয়োগ করে শেয়ার বাজারে। কনভেনশনাল ব্যাংকগুলির জন্য আমানত অর্থ অব্যবহৃত অবস্থায় ফেলে রাখা অসম্ভব। কারন তারা আমানতের উপর নিদৃষ্ট হারে সুদ দিতে বাধ্য। তাই তারা বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে শেয়ার বাজারকে বেছেনিয়েছিল। অন্য দিকে ব্যাংক থেকে এবং নিজস্ব উদ্যোগে বিনিয়োগকারীরা শিল্প স্থাপন করতে গিয়ে বিদ্যুত এবং গ্যাস সুবিধা না পেয়ে এবং সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির শিকার হয়ে শিল্প স্থাপন করতে ব্যার্থ হয়ে তাদের মূলধনকে শেয়ার বাজারে নিয়ে আসেন। অন্যদিকে বুকবিল্ডিং বা ডিরেক্ট লিস্টিং পদ্ধতিতে কিছু কোম্পানি অতি উচ্চ মুল্যে তাদের শেয়ার বিক্রি করে টাকা নিয়ে যায় বাজারের বাইরে কিন্তু এই কোম্পানিগুলি শেয়ার বাজারে রয়ে যায় অতি উচ্চ মুল্যায়িত অবস্থায়। শেয়ার বাজারের এই অবস্থার সাথে আবার যুক্ত হয়েছে তথাকথিত মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বা ইউনিপেটু জাতিয় কোম্পানি সমূহের বিস্তার। এই কোম্পানিগুলির অতি সল্প সময়ে(কোন ক্ষেত্রে তিনমাসের মধ্যে)টাকা দিগুন করার অফারের প্রেক্ষিতে অনেকেই এখন শেয়ার বাজারে নাএসে বিনিয়োগ করছেন এই কোম্পানি গুলিতে ফলে কমে যাচ্ছে বাজারের শেয়ার ক্রয়ের ক্ষমতা।
সব কিছু মিলিয়ে আমাদের শেয়ার বাজারে সৃষ্টি হয় একটি বুদবুদ এর যার বিস্ফোরন মাত্র দুদিনে পথে বসিয়ে দিয়েছে অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীতে।
গত কয়েকদিন থেকেই সূচক নিন্ম মুখি হলেও গতকালের মত বিশাল অংকের পতন এবং আজকের এক ঘন্টায় সমান পতন আমাদের স্টক মার্কেটের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আরোবিমুখ করে তুলছে।
গত কয়েকমাস ধরেই বাজার বিশেষজ্ঞরা এই পতন ঠেকানো এবং অতিমুল্যায়িত বাজারকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিতে এসইসি ও সরকারকে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু উভয় কর্তপক্ষই আমলাতান্ত্রিক গদাই লস্করি চালে নিচ্ছিলেন তাদের পদক্ষেপ। অন্য দিকে শেয়ার বাজারে ব্যাংক সমূহের বিনিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকএর হঠাৎ করে বেশি নিয়ন্ত্রন আরোপ এবং বিভিন্ন পদক্ষেপ আমাদের অস্থির শেয়ার বাজারকে আরো অস্থিতিশিল করে তোলে। রাতারাতি ব্যাংকগুলির বিনিয়োগ ঝুঁকি হ্রাসের চেষ্টা ঝুঁকিতে ফেলে দেয় লক্ষলক্ষ বিনিয়োগকারীদের। অথচ ব্যাংক সমূহের শেয়ার বাজারের অতিরিক্ত বিনিয়োগের বিষয়টি প্রায় দেড় বছর আগে থেকে আলোচিত হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক এতদিন কোন পদক্ষেপ নেয়নি।
সরকার ও এসইসির বিভিন্ন কার্যকলাপ ও সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদের বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে তারা লাঠি দিয়েই শেয়ার বাজারকে নিয়ন্ত্রনে আনতে উৎসাহি। অন্য দিকে এই দর পতনটিতেকস্বাভাবিক নয় বলেই সকল বাজার বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেছেন। গতকালের বিশাল পতনের পর তারা বলেছিলেন মুল্য যথেষ্ট সংশোধন হয়েছে এখন সাময়িকভাবে হলেও বাজার উর্ধগামী হবে। কিন্তু তাদের বক্তব্যকে অসাড় প্রমানিত করে মাত্র এক ঘন্টায় আজকে শেয়ার বাজারের এই পতন। শেয়ার বাজারে অতিমুল্যায়িত শেয়ার অবমুল্যায়নের মাধমে সূচক কমে যাওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে সকলেই অবহিত ছিলেন। কিন্তু সাধারন বিনিয়োগকারীরা উত্তেজিত হয়েছেন অতি অল্প সময়ে এই পতন দেখে। বিশেষজ্ঞরাও এটা আশা করেননি। তারা ধাপে ধাপে সূচক কমে যওয়ার কথা বলেছিলেন।
আজকে ট্রেড বন্ধ রেখে এসইসি যে সকল সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার খুববেশি কোন প্রভাব শেয়ার বাজারের ফেলবে বলে মনে হয় না। মানুষের মনে এখনও প্রচুর শংকা রয়েছে।

শেয়ার বাজারের বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এই বাজারের গতি প্রকৃতি কোন গানিতিক বা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষন দিয়ে বের করা সম্ভব নয়। এটি বর্তমানে ব্ল্যাকহোলের মত অবস্থায় চলে এসেছে।
যাতে কেবল কিছূ ঢকে আর বের হতে পারেনা। ব্ল্যাক হোল কোন বৈজ্ঞানিক তত্ব অনুযায়ি চলেনা। আমাদের শেয়ারবাজার ও যেন এখন সেই রকম হয়ে গেছে। আজকের দিনটি যেন আমাদের শেয়ার বাজারকে নিয়ে গেছে একটি ব্ল্যাকহোলে যেখানে কোন প্রতিষ্ঠিত সত্য ও গানিতিক ফর্মুলা কাজ করেনা। অনিশ্চয়তাই যেখানে সত্য।
আজকের দিনটিকে আমরা ব্ল্যাকহোল মানডে বলে অভিহিত করতে পারি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন