বুধবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২

গ্রামীন ফোন! টেলিনর বনাম ডক্টর ইউনুস। একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

গ্রামীন ফোন! টেলিনর বনাম ডক্টর ইউনুস। একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

গ্রামীন ফোনের মুল সপ্ন দ্রষ্টা হচ্ছেন ডক্টর ইকবাল কাদির। ১৯৯০-৯৪ সালে তিনি তখন একটি বিনিয়োগ পরামর্শক সংস্থা পরিচালনা করতেন। তিনি সে সময় চিন্তা করেন যে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিভিন জিনিস উৎপাদিত হয়। কিন্তু শহর বা ভোক্তা শ্রেনীর সাথে কোন সহজ যোগাযোগ বা তথ্য আদান প্রদান ব্যবস্থা না থাকার কারনে উৎপাদনকারী এবং ভোক্তার মধ্যে একটি বড় অংশ দালাল বা ফড়িয়ারা নিয়ে যাচ্ছে এবং ভোক্তাদের চাহিদা সম্পর্কে উৎপাদকের ও কোন ধারনা থাকেনা। ডক্টর ইকবাল কাদির এসময় নিজের উদ্যোগে একটি বিনিয়োগ সংস্থা গনফোন লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ডক্টর ইকবাল এর পর বাংলাদেশে আসেন এবং সরকার ও তার পরিচিত জনদের সাথে বাংলাদেশে গ্রামে গ্রামে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক স্থাপন বিষয়ে আলোচনা করেন। সে সময় বাংলাদেশে একমাত্র মোবাইল ফোন অপারেটর প্রতিষ্ঠান টি ছিল সিটিসেল। উন্নত টেকনলজি সত্বেও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারনে এবং দেশিয় উদ্যোক্তাদের অদুরদর্শিতার জন্য পঞ্চাশ শতাংশ দেশিয় বিনিয়োগ থাকা এই কোম্পানিটি তখন সাধারন মানুষের হাতের নাগালে মোবাইল ফোনটি পেীছিয়ে দিতে সক্ষম হয়নি। ডক্টর ইকবাল কাদির এর সাধারন মানুষের নাগালের মধ্যে মোবাইল ফোন পেীছে দেয়ার পরিকল্পনা তখন অনেকের কাছেই অসম্ভব মন হয়েছিল। এমনকি খোদ ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসও প্রথমে এই পরিকল্পনাটিকে গুরুত্ব দেননি। তবুও শেষ পর্যন্ত ডক্টর ইকবাল কাদির ডক্টর ইউনুস কে তার পরিকল্পনায় বিনিয়োগে সম্মত করাতে সক্ষম হন। গ্রামীন ব্যাংক এর সিস্টার কনসার্ন হিসেবে ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস গ্রামীন টেলিকম প্রতিষ্ঠা করেন। এই উদ্যোগের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন তখন দেখাদেয় কারিগরি সহায়তা। ডক্টর ইউনুস নরওয়ের বৈেদশিক সাহাজ্য সংস্থার সাথে তার পুর্ব সম্পর্কের সুবাদে টেলিনর কে বিনিয়োগ ও কারিগরি সহায়তা দিতে রাজি করাতে সক্ষম হন। জাপানের মারুবেনি কর্পোরেশনও বিনিয়োগে রাজি হয়। টেলিনর প্রথমে বাংলাদেশে বিনিয়োগে তেমন আগ্রহি ছিলনা। তারা তখন প্রাথমিকভাবে পাঁচবছরের জন্য বিনিয়োগে রাজি হয়। কথা ছিল তাদের শেয়ারের বেশিরভাগ অংশ তারা গ্রামীন টেলিকম এবং গনফোনের কাছে বিক্রি করে দিয়ে যাবে এবং ব্যবস্থাপনার দায়িত্বও তারা হস্তান্তর করবে। এরপর স্থাপিত হয় গ্রামীন ফোন। প্রথম পর্যায়ে গ্রামীন ফোনের শেয়ার হোল্ডিং স্ট্রাকচার ছিল এরকম।
১.টেলিনর,নরওয়ে ৫১%
২.গ্রামীন টেলিকম ৩৫%
৩.মারুবেনি কর্পোরেশন,জাপান ৯.৫%
৪.গনফোন, ৪.৫%
কারিগরি সহায়তা নিশ্চিত হলে ডক্টর ইউনুসের ব্যাক্তিগত চেষ্টায় মোবাইল টেলিফোন অপারেটরের লাইসেন্স লাভ করে গ্রামীন ফোন। ১৯৯৭ সালের ২৬ শে মার্চ কমার্শিয়াল অপারেশন শূরু করে গ্রামীন ফোন।
বছর দুয়েকএর মধ্যেই এর নেটওয়ার্ক সম্প্রসারীত হয় ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তি এলাকা,চট্টগ্রাম,সিলেট এবং খুলনায়। গ্রামীন ফোনের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান গ্রামীন টেলিকম এসময় শুরু করে ভিলেজ ফোন এর ব্যবসা। গ্রামীন ফোনের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে গ্রামীন ব্যংক থেকে ঋন দিয়ে গ্রামের দরিদ্র মহিলাদের মধ্যে বিক্রয় করা হয় মোবাইল ফোন। তখন বাংলাদেশে টিএন্ডটির এনডব্লিউডি কল এর রেট ছিল ২০-৪০ টাকা পর্যন্ত। সুতারং প্রথমে মাত্র ১০-১২ টাকা ও পরে মিনিট মাত্র সাত টাকা রেটে গ্রামীন ফোনের মাধ্যমে এক শহর থেকে অন্য শহরে কল করার সুযোগ ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠে। গ্রামীন ফোন আস্তে আস্তে বিস্তৃত হতে থাকে সারা দেশে। এর মধ্যে গ্রামীন ফোন ১৯৯৯ সালে লাভ করে একটি সুবর্ন সুযোগ। বাংলাদেশ রেলওয়ে কতৃক স্থাপিত দেশব্যাপি ফাইবার অপটিক কেবল নেটওয়ার্ক টি মেনটেনন্যান্স এবং ব্যবহারের ঠিকাদারি লাভ করে গ্রামীন ফোন। গ্রামীন ফোন দ্রুত এই সুযোগের সদব্যবহার করে দেশের প্রতন্ত অঞ্চলে তাদের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারিত করে। প্রায় জায়গাতেই তারা রেলওয়ের কক্ষে সল্প ভাড়ায় তাদের বেইস ট্রান্সরিসিভার ষ্টেশন বা বিটিএস স্থাপন করে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মফস্বল শহর এবং ব্যবসা কেন্দ্রই রেল ষ্টেশনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিধায় তারা সহযেই তাদের গ্রাহক বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। এভাবে গ্রামীন ফোন দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্রাহক অর্জনে সক্ষম হয়। ইতঃমধ্যে গ্রামীন ফোনের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান টেলিনর দেখতে পায় বাংলাদেশে বিপুল পরিমান লাভের সম্ভাবনা। বাংলাদেশের একটি বিশাল জনশক্তি দেশের বাইরে কর্মরত বিধায় বিপুল পরিমান আর্ন্তজাতিক কল এদেশ থেকে আসা যাওয়া করে। এই কলগুলি তখন ছিল বিটিটিবি এর পুর্ন নিয়ন্ত্রনে। ঔপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টি ভঙ্গিতে পরিচালিত বিটিটিবি এই খাতে সাধরন গ্রাহকদের কোন রকম সুবিধাই দিতে রাজি ছিলনা। আমি ব্যাক্তিগত ভাবে দেখেছি বিটিটিবি এর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে তখন বাইরের দেশগুলির আন্তর্জাতিক কলের মুল্য ও আমাদের দেশের আন্তর্জাতিক কলের রেটের বিরাট পার্থক্যের কারন জানতে চাইলে তিনি বলেন যে টেলিফোন শুধূমাত্র বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য সুবিধা হওয়া উচিত। রেট কমালে এটি সাধারন মানুষ বেশি ব্যবহার করবে! সেই জন্য কল রেট বেশি রাখা হেেয়ছে। এই অবস্থায় গ্রামীন ফোন দেশে ভিওআইপি প্রযুক্তি ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক কল পরিচালনা শুরু করে অতি গোপনে। বিটিটিবির কর্মকর্তা দের এবং সরকারের দুরদর্শিতার অভাব এবং ঔপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা একটি আধুনিক প্রযুক্তির বৈধ ব্যবহার থেকে দেশের মানুষকে দূরে ঠেলে দেয়। গ্রামীন ফোন এই সুযোগ গ্রহন করে। গ্রামীন ফোন ২০০৩ সাল থেকেই লাভ করতে শুরু করে। ২০০৪ সালে গ্রামীন ফোন ১৫ লক্ষ গ্রাহকের কাছে পেীছাতে সক্ষম হয়। বিপুল পরিমান গ্রাহক ও লাভের অংক টেলিনর কে বাংলাদেশে ব্যবসার ব্যাপারে অতি আগ্রহি করে তোলে। টেলিনর গ্রামীনফোনে তাদের শেয়ার বাড়াতে সচেষ্ট হয়। ততদিনে বাংলা দেশে অন্য দুটি জিএসএম অপারেটর একটেল ও বাংলালিংক তাদের সেবার মান ও পরিধি বৃদ্ধি করেছে এবং সিটিসেলও তার পুরানো মানসিকতা ঝেড়েফেলে ব্যবসায় উদ্যোগি হয়েছে। টেলিনর এই পর্যায়ে গ্রামীরফোনের উপর তাদের নিয়ন্ত্রন বাড়াতে প্রথম থেকে গ্রামীনফোনে কর্মরত উচ্চপদস্থ বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের ছাঁটাই করা শুরু করে। গ্রামীন ফোনের সপ্নদ্রষ্টা ডক্টর ইকবাল কাদির প্রথম থেকে গ্রামীনফোনের ফিনান্স ডিরেক্টর থাকলেও ২০০১ সালে তিনি হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান। বাংলাদেশে টেলিকম মার্কেটিংএর অন্যতম সফল ব্যাক্তিত্ব মেহবুব চেীধুরি যিনি মার্কেটিং ডিরেক্টর ছিলেন তাকে অবসর দেয়া হয়। কাস্টমার সার্ভিস ডিরেক্টর নায়লা চেীধুরি পাকিস্তানে টেলিনরের নতুন প্রজেক্ট এ ডিরেক্টর হিসেবে চলে যান । অন্যান্য অনেক পদেও গ্রামীন ফোনের শুরুথেকে কর্মরত দক্ষ ও অভিজ্ঞ বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের বদলে নিয়োগ দেয়া হয় অদক্ষ,অনভিজ্ঞ ও জি হুযুর টাইপের বাংলাদেশি কর্মকর্তদের। কয়েকজন বিশেষ করে এক উচ্চ পদস্থ মহিলা কর্মকর্তা তো ছিলেন স্রেফ শো-পিস। এর মধ্যে অনেকেই অতি অল্প সময়ে ডেপুটি ম্যানেজার বা এধরনের পদ থেকে জেনারেল ম্যানেজারের পদে পদোন্নতি পান। এভাবে পদন্নোতি দেয়ার পিছেনে ছিল এরা নিজেদের পদ ও বেতনের লোভে টেলিনর এর কোন রকম বিরোধিতা বা দেশিয় বিনিয়োগকারীদের প্রতি সহানুভুতির কোন সুযোগ পাবেনা। টেলিনর এরপর গ্রামীনফোনে তার শেয়ার বিক্রয় করে দেয়ার জন্য ডক্টর ইকবাল কাদিরের উপর চাপ সৃস্টি করে। হার্ভাড বিজনেস রিভিউতে প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যায় ২০০৪ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি টেলিনরের দুজন কর্মকর্তা বস্টনে তার সাথে দেখা করে শেয়ার বিক্রির জন্য চাপ দেয়। তখন রাজি না হলেও নানামুখি চাপের কারনে ২০০৫ সালের শেষের দিকে ডক্টর ইকবাল কাদির তার শেয়ার বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। তথাপি তিনি গনফোনের ৪.৫ শতাংশ শেয়ারের মধ্যে ২.৫ শতাংশ গ্রামীন টেলিকম কে বিক্রি করেন। বাকি ২ শতাংশ টেলিনর অধিগ্রহন করে। মারুবেনি কর্পোরেশনের শেয়ার পুরোটাই টেলিনর কিনে নেয়। ই্তঃমধ্যে শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য সরকার গ্রামীন ফোনের উপর চাপ সৃস্টি করে। এ অবস্থায় গ্রামীন টেলিকমের শেয়ার অধিগ্রহনের জন্য টেলিনরের চেষ্টা সাময়িক ভাবে কমে যায়। শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত হতেও গ্রামীনফোন (মূলত টেলিনর) গড়িমসি করতে থাকে। তাদের যে সকল খোঁড়া অজুহাত ছিল তালিকাভুক্তনা হওয়ার পিছনে তার মধ্যে একটি ছিল বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের নাকি গ্রামীন ফোনের শেয়ার কেনার মত প্রয়োজনিয় বাজার মূলধন নেই। শেয়ার ছাড়ার সময়ও টেলিনর গ্রামীন টেলিকম ও টেলিনর এর অংশ থেকে সমান পরিমান শেয়ার অফলোড করানর চেষ্টা করে যাতে গ্রামীন টেলিকমের অংশ কমে যায় তবে শেষ পর্যন্ত গ্রামীন টেলিকম তার অংশ থেকে ৩ শতাংশ শেয়ার ছাড়তে রাজি হয়। এর মধ্যে ঘটে যায় ১/১১। এই সময় ভিওআইপিএর অভিযোগে অন্যান্য টেলিকম সংস্থার সুইচে ও অফিসে যেীথবাহিনী অভিযান চালালেও গ্রামীনফোন বেচে যায়। তবে গ্রামীনফোনকে একটি অংক জরিমানা করা হয়। তবে এসময়ই গ্রামীন ফোন শেয়ার বাজারে আসতে বাধ্য হয় পুর্ববর্তি সরকারের উদ্যোগের ধারাবাহিকতায়। বর্তমানে গ্রামীন ফোনের শেয়ার হোল্ডিং এর অবস্থা নিন্মরুপ।
১.টেলিনর,নরওয়ে ৫৫.৮%
২.গ্রামীন টেলিকম বাংলাদেশ ৩৪.২%
৩.শেয়ার বাজারের বিনিয়োগ কারিরা ১০%
উল্লেখ্য শেয়ার বাজারের ১০% এর মধ্যে অর্ধেক গ্রামীন ফোনের কর্মকর্তা/কর্মচারী ও বিভিন্ন র্পুব নির্ধারিত প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর প্লেসমেন্ট শেয়ার।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে দেশিয় বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত পিএসটিএন অপারেটরগুলি বন্ধ করে দেয় হয় ভিওআইপি করার অজুহাতে। অন্যদিকে গ্রামীনফোন এখন একই ব্যাবসা করে যাচ্ছে মুক্তভাবে।
সমস্যাথেকে মুক্তি পেয়ে টেলিনর এখন গ্রামীন টেলিকমএর শেয়ার অধিগ্রহনের জন্য তাদের চেষ্টা পুনরায় জোড়েশোরে শুরু করেছে। তারই জন্য প্রচার প্রপাগান্ডার অংশ হিসেবে যে নরওয়ে ডক্টর ইউনুস কে নোবেল পুরুস্কার দিয়ে সন্মানিত করেছে তারাই এখন তার চরিত্র হনন এর চেষ্টা করছে।
গ্রামীন ব্যাংক ও ডক্টর ইউনুস এর কার্যক্রম নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ অনেক আগের। সেসময় অভিযোগকারীদের মেীলবাদি বলেও অনেকে প্রচার করত। হঠাৎ করে এতদিন গ্রামীন ব্যাংক ও ডক্টর ইউনুসের বন্দনায় লিপ্ত ওয়েব ভিত্তিক সংবাদ সংস্থার হেডলাইনে ডক্টর ইউনুসের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন অবশ্যই অবাক হওয়ার মত। পরদিন হরতালের মত ঘটনা বা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বদলে সারাদিন ধরে এই বিষয়টি হেডলাইনে রাখাও এই প্রচারনার উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি করে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন