বুধবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২

শাহানশাহ ই গজল। মেহদি হাসান।

দুনিয়া কিসিসে পেয়ার হ্যায়,মুঝে তুম নযর সে, রনজিস ই সহি। অসংখ্য হৃদয় আলোকিত উদ্বেলিত করা গজল এর শিল্পি মেহদি হাসান চলে গেছেন আজ ১৩ই জুন,২০১২। তার উপাধি ছিল শাহানশাহ ই গজল বা গজল সম্রাট। আধুনিক গানের যন্ত্রপ্রধান সংগিতের মধ্যেও বানী ও সুর প্রধান গজল কে উপমহাদেশের তরুন সমাজের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে তার অবদান অবিস্মরনিয়। পাশাপাশি তিনি আধুনিক উর্দু,হিন্দি এবং বাংলা গানও গেয়েছেন। পাকিস্তানি উর্দু ছায়ছবির অসংখ্য হিট গানের প্লে ব্যাক করেছেন তিনি। তবে তার প্রধান পরিচয় অবশ্যই গজল শিল্পি হিসেবে। তার গাওয়া গানের সংখ্যা ২০০০০ এর উর্ধে।
মেহদি হাসান এর জন্ম বর্তমান ভারতের রাজস্থানের বিখ্যাত গ্রাম লুনি তে ১৯২৭ সালের ১৮ই জুলাই। ছোট হলেও লুনি গ্রামটি সংগিতের জন্য বিখ্যাত। সত্যজিত রায় তার ”গুপি গাইন বাঘা বাইন” এবং ” সোনার কিল্লা” ছবির শুটিং করেছিলেন সেখানে এবং এই ছায়ছবিতে ব্যবহার করেছিলেন সেই গ্রামের অধিবাসিদের গাওয়া ও বাজান সঙ্গিত। মেহদি হাসান এর পিতা উস্তাদ আজিম খান ও চাচা উস্তাদ ইসমাইল খান এর থেকে সঙ্গিতে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। তার পরিবার অনেক পুরুষ ধরেই চলে আসছে সঙ্গিত চর্চার ধারা। অল্প বয়সেই তিনি বিভিন্ন জলসায় গান গাইতে শুরু করেন। প্রধানত ধ্রুপদি ও খেয়াল গানই গাইতেন তখন। ১৯৪৭ সালে উপ মহাদেশ বিভক্ত হওয়ার পর তিনি তার ভাই সহ চলে আসেন পাকিস্তানে। পাঞ্জাবের একটি ছোট শহরে সাইকেলের দোকানে ছোট্ট কাজ নিয়ে শুরু করেন নতুন জিবন। পরে ট্রাকটর ও গারি মেকানিক হিসেবেও কাজ করেন জিবন যাপনের জন্য। কিন্তু সঙ্গিত এর চর্চা কখনই বন্ধ করেননি শত প্রতিকুলতা সত্বেয়। ১৯৫৭ সালে রেডিওতে গান গাওয়ার সুযোগ পান তিনি। প্রথম দিকে শুধু উচ্চাঙ্গ সঙ্গিত গাইতেন কিন্তু এরপর গাইতে শুরু করেন গজল যা তাকে পেীছে দেয় খ্যতি ও সাফল্যের উচ্চ স্তরে। ষাটের দশকের শুরুতে ছায়ছবিতে প্লেব্যাক গাওয়া শুরু করেন তিনি। ছায়াছবিতে গাওয়া তার প্রথম গানটি ছিল ফয়েজ আহমদ ফয়েজ রচিত বিখ্যাত চির সবুজ গজল ”গুল মে রঙ্গ ভরে বাদল বাহা চলে”। ছায়ছবিতে গজল ছাড়াও আধুনিক হিট গান ও গেয়েছেন তিনি। এরমধ্যে রয়েছে যব কোই পেয়ারসে বুলায়গা, মুঝে দিলসে না ভুলানা, ইয়ে তেরে আনা, রাফতা রাফতা ও মেরে এই ধরনের চিরনতুন গান। তৎকালিন পাকিস্তানের প্রায় সকল শিল্পির সঙ্গেই গান গেয়েছেন তিনি। আমাদের দেশের ফেরদেীসি রহমানের সঙ্গেও বিখ্যাত গান রয়েছে তার। বাংলায় ও গান গেয়েছেন তিনি। তার বাংলা গানের একটি ক্যাসেটও বের হয়েছিল। বাংলা ছায়ছবিতে তার গাওয়া হিট গান রযেছে ”ঢাকো যতনা নয়ন দুহাতে”। মেহদি হাসানের একটি বড় কাজ বাহদুর শাহ জাফর,দাগ, হসরত মোহানির মত বিখ্যাত উর্দু গজল রচয়িতাদের গান নতুন করে পরিবেশন করা। শেষ মুঘল সম্রাট বাহদুর শাহ জাফরের রচিত ”বাত করনি মুঝে মুশকিল কাভি অ্যায়সে নাথে” এবং ”না কিসি আঁখ কি নুর হু” গজল দুটি মেহদি হাসানের কণ্ঠে প্রভুত জনপ্রিয়। রেডিও,টেলিভিশন, ক্যাসেট রেকর্ড, প্লে ব্যাক, এবং জলসায় অপ্রতিদনদ্বি শিল্পি ছিলেন মেহদি হাসান। হামদ,নাত ও তিনি গেয়েছেন অনেক। তার গাওয়া নাত ”লওহ ভি তু কলব ভি তু” অত্যন্ত জনপ্রিয়।
আশির দশকের শেষ দিকে বয়স ও অসুস্থতার জন্য প্লেব্যাক এবং জলসা কমিয়ে দেন তিনি। একবিংশ শতকের শুরুতে প্যারালাইসিস এ আক্রান্ত হন তিনি। এরপর নিয়মিত গান বন্ধ করে দিলেও মাঝে মধ্যে টেলিভিশন বা মিক্সড এলবামের জন্য গান গাইতেন তিনি তার মধ্যে দেশাত্ব বোধক গানই প্রধান। অসুস্থ অবস্থায় গান কয়েকদিন ধরে গেয়ে একেকটি গান রেকর্ড করা হতো। এসময় তার গাওয়া একটি গান "ইয়ে ওয়াতান তুমহারি হ্যায়" সম্পর্কে ইউ টিউবে এক ভারতিয় মন্তব্য করেছিলেন যে তিনি একজন ভারতিয় হয়েও এই গানটি শুনে অশ্রু সম্বরন করতে পারেননি। ভারতের কিংবদন্তি লতা মুঙ্গেশকর বলে ছিলেন তার মেহদি হাসানের সাথে গান গাওয়ার ইচ্ছের কথা। সেই আশা তার পুর্ন হয় ২০০৯ সালে । এইচএমভি দুজনের হাওয়া একমাত্র ডুয়েট "তেরে মিলনা বহুত আচ্ছা লাগতা হ্যায়" প্রকাশ করে। সম্ভবত এটাই তার শেষ প্রকাশিত গান।
দির্ঘ অসুস্থতার পর গতকাল ১৩ই জুন ২০১২ সালে করাচির আগা খান হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন তিনি।
পাকিস্তানের সর্বোচ্চ পুরুস্কার প্রাইড অব পারফর্মেন্স ও হিলালে ইমতিয়াজ সহ দেশে বিদেশে অসংখ্য পুরুস্কারে ভুষিত হন তিনি। তার চেয়েও বড় হচ্ছে পরস্পর প্রতিদন্বি দুই রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানে তার অসম্ভব জনপ্রিয়তা। সেই সঙ্গে উপমহাদেশে ও এর বাইরেও তার জনপ্রিয়তা অপ্রতিদন্বি। বাংলাদেশে তিনি বেশ কয়েকবার এসেছেন। স্বাধিনতার আগে অনেক জলসায় এসেছেন। স্বাধিনতার পর বিটিভির ২৫ বছর পুর্তি উপলক্ষে একক সংগিতানুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেছিলেন তিনি।
তার জিবনের একটি উল্লেখ যোগ্য ঘটনা হচ্ছে নেপালের রাজদরবারে সঙ্গিত পরিবেশনের সময় তার বিখ্যাত জিন্দেগি ম্যায় তো সাভি পেয়ার কিয়া করতে হ্যায় গানটি গাইতে গিয়ে হঠাত খেই হারিয়ে ফেলেন তিনি, এই সময় নেপালের পরোলকগত রাজা বিরেন্দ্র বির বিক্রম শাহদেব নিজেই গেয়ে উঠেন তার পরের লাইন, ম্যায় তো মরকরভি মেরে জান তুঝে চাহউঙ্গা।
আমরা এই কিংবদন্তি শিল্পির রুহ এর মাগফিরাত কামনা করছি।
তিনি একদিন গেয়ে গেছেন "মুঝে দিলসে, না ভুলানা, চাহে রুকে ইয়ে যামানা"। আমরা তাকে ভুলতে পারবনা। কারন তিনি ফিরে আসবেন "কাভি নাগমা বনকে,কাভি বনকে আসুঁ"। কখনও সুর হয়ে কখনও বা অশ্রু।


যখন সাফল্যের শির্ষে


মৃত্যর কয়েকদিন আগে।


ফেরদেীসি রহমানের সাথে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন