বুধবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২

হাসান আল বান্না থেকে মুহাম্মদ মুরসি। জনতার মুখ চেপে ধরতে উদ্যত শোষক গোষ্ঠি আর জনতার লড়াই।

১৯২৮ সালের মার্চ মাসের কোন এক দিন। মিসরের লোহিত সাগরের তীরবর্তি বন্দর নগরি ইসমাঈলিয়ার এক কফি শপে মিলিত হলেন সাত বন্ধু। এদের মধ্যে প্রধান স্কুল শিক্ষক উস্তাদ হাসান আল বান্না। সকলে মিলে আলোচনা করছিলেন পাশ্চাত্য প্রভাবিত এই ইসমাঈলিয়া নগরির নৈতিক অবস্থা এবং দেশের অবস্থা। একসময় তারা সিদ্ধান্ত নিলেন দেশের মানুষের জন্য কিছু করার। নিজেদেরকে তারা অভিহিত করলেন ইখওয়ান উল মুসলিমিন অর্থাত মুসলিম ভাতৃসঙ্ঘ বলে। সে সময় ইসমাঈরলিয়া বন্দর নগরীটি ছিল মূলত সুয়েজ কোম্পানির নিয়ন্ত্রনে। মিসরের বুক চিরে চলে গেছে সুয়েজ খাল। সেই খাল ব্যবহার করে দক্ষিন ও পুর্ব এশিয়ার উপনিবেশগুলি থেকে লুন্ঠিত সম্পদ নিজ দেশে পাচার করে বৃটেন ও ফ্রান্সের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলি। মিসর তখন আধা স্বাধিন। দেশে একজন বাদশাহ ও নির্বাচিত মন্ত্রি পরিষদ থাকলেও মুল নিয়ন্ত্রক বৃটিশ রাজপ্রতিনিধি বা রেসিডেন্ট। বিদেশি নাগরিক রা মিসরের আইন এর উর্ধে থেকে কাজ করেন। অন্যদিকে সাধারন মিসরিয় রা যতই যোগ্যতা সম্পন্নই হোননা কেন সুয়েজ কোম্পনিতে শ্রমিকের উপের চাকরির সুযোগ নাই তাদের। ইসমাঈলিয়ার সেই সময় একই সাথে সমাজ সংস্কার আর আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার প্রতিষ্ঠায় সেই তরুন দল যাদের করো বয়স তখন পচিশ পার হয়নি যে আন্দোলনের সূচনা করেছিল তার প্রভাব এখন মিসর ছাড়িয়ে সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের আন্দোলনে ভিত হয়ে উঠে পশ্চিমা শোষক আর তাদের তাঁবেদার গোষ্ঠি। চরম দমন আর নিপিড়নের শিকার হলো ইখওয়ান আল মুসলিমিন। ১৯৪৯ সালে শহিদ করে দেয়া হলো এর প্রতিষ্ঠাতা হাসান আল বান্নাকে। ১৯৫২ সালে কর্নেল নগিব এর নেতৃত্বে এক বিপ্লব হলো সেখানে। ঔপনিবেশিকরা সরাসরি নিয়ন্ত্রন হারাল। গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করার কথা দিল নতুন বিপ্লবি কাউন্সিল। কিন্তু তার মধ্যে ঢুকে গেছে তখন কয়েকজন বিশ্বাসঘাতক। জামাল আবদুল নাসের বিপ্লবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে জেনারেল নগিবকে সরিয়ে একনায়কের স্বৈরশাসন কায়েম করল। ষাট বছর ধরে মাত্র তিনজন শাসক শাসন ও শোষন করে গেছে মিশরকে।
কিন্তু শত অত্যাচার নিপিড়ন,ফাঁসি,গুপ্তহত্যা ও দমিয়ে রাখতে পারেনি মিশরের জনগনকে। একদিকে ইসরাইলি আগ্রাসন। অন্যদিকে পশ্চিমা শক্তির মদদ পুষ্ট সামরিক শক্তিতে বলিয়ান শাসকদের অত্যাচার লুটপাটের প্রতিবাদে দেড় বছর আগে রাস্তায় নেমে আসে জনগন। পদত্যাগ করতে বাধ্য হন প্রেসিডেন্ট হুসনি মুবারক। সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রন গ্রহন করে। কিন্তু কায়েমি স্বার্থবাদি শক্তি এত সহজে তাদের ক্ষমতা ছাড়তে রাজি নয়। জনগনের বিপ্লবকে ছিনতাই করার প্রচেষ্টা শুরু হয় পশ্চিমা শক্তির প্রত্যক্ষ মদদে। অনেক ধানাই-পানাই করে প্রথমে সংসদ নির্বাচন দেয় শাসনকারী সেনা পরিষদ। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে ইখওয়ান বা মুসলিম ব্রাদারহুড এর সমর্থিত রাজনৈতিক দল। নতুন সংবিধান প্রনয়নের কাজ শুরু করে তারা। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কাজ ও শুরু হয়। কিন্তু সংসদ নির্বাচনে জনগনের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে কায়েমি শক্তি নতুন ষড়যন্ত্রের সুচনা করে। হুসনি মুবারক এর অন্যতম সহযোগি আহমদ শফিকে প্রার্থি করা হয় প্রেসিডেন্ট পদে। প্রথমে তার প্রার্থিতা নতুন সংসদ প্রনিত আইনে বেআইনি হলেও হুসনি মুবারকের আমলে নিযুক্ত বিচারপতিদের সহায়তায় প্রথমে তার প্রার্থিতা নিশ্চিত করা হয় অন্যদিকে এক পর্যায়ে সংসদ বাতিল করে দেয়া হয়। সামরিক পরিষদকে নির্দেশ দেয়া হয় তাদের পছন্দমত একটি কনভেনশন তৈরি করে নতুন সংবিধান প্রনয়নের। এই গনতান্ত্রিক! আদেশ নজির বিহিন। নির্বাচিত সংসদ সংবিধান প্রনয়ন করবে না বরং অনির্বাচিত ব্যাক্তিরা সংবিধান প্রনয়ন করবে।
এদিকে পেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথম স্থান অধিকার করেন ব্রাদারহুড সমর্থিত জাস্টিস পার্টির মুহাম্মদ মুরসি। আর সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আহমদ শফি দ্বিতিয় স্থান অধিকার করে। যদিও কমপক্ষে শতকরা ৫০ ভাগ ভোট কেউই লাভ করেনি। এ অবস্থায় দ্বিতিয় দফা নির্বাচনের ঘোষনা দেয়া হয়। নির্বাচনের বেসরকারি ফলাফলে মুহ্ম্মাদ মুরসির বিজয় নিশ্চিত হলেও বিভিন্ন কারীগরি করে আহমদ শফি কে বিজয়ি করার ষড়যন্ত্র শুরু হয় সাথে সাথেই। গত বৃহস্পতিবার ফলাফল ঘোষনার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত টানাটানি করে আজকে মুহাম্মদ মুরসিকে বিজয়ি ঘোষনা করল নির্বাচন কমিশন।
অভিনন্দন জনাব মুরসি।
তার সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। জনগনের প্রত্যাশা একটি গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র্। কিন্তু গত ষাট বছর ধরে নিজেদেরকে ক্ষমতার কেন্দ্রে দেখা সেনাবাহিনী আর পশ্চিমা শক্তির প্রতি পুর্ন অনুগত বিচার বিভাগ তাকে জনগনের ইচ্ছা পুরুন করতে কতটুক দেবে তা চিন্তার বিষয়। আমরা আশা করব একটি জনগনের সরকার মিশরে প্রতিষ্ঠিত হবে এবার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন