বুধবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২

একজন নাজমুদ্দিন আরবাকান।একটি ফিনিক্স।

নাজমুদ্দিন আরবাকান এর ইন্তেকালের সাথে সাথে তুরুস্কের এবং ইসলামের ইতিহাসের এক যুগের অবসান হলো। যে যুগে ইসলাম ধ্বংস ও বিকৃতির অবস্থা থেকে পুনরায় বিজয়ির আসনে অভিষিক্ত হয়েছে।
নাজমুদ্দিন আরবাকানের জন্ম ১৯২৬ সালে। এর দুবছর আগেই তুরুস্ককে আধুনিক রাষ্ট্রে পরিনিত করার উদ্দেশ্যে কামাল আতাতুর্ক অবলুপ্ত করেছেন খলিফা ও সুলতানের পদ এবং দেশকে করেছেন ধর্মহিন। কৃষ্ন সাগরের তিরে সিনোপ শহরে জন্ম নেন আরবাকান। পিতা মুহাম্মদ সাবরী ছিলেন একজন বিচারক। দরিদ্র না হলেও সাধারত তবে অভিজাত বংশের সন্তান তিনি। ইস্তাম্বুলের ভাল স্কুলে লেখাপড়া করার সুযোগ পান তিনি। ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং এ গ্র্যাজুয়েট হন তিনি এরপর। এখানে তার ফলাফল ছিল জিপিএ ৪.০০ এর মধ্যে ৪.০০। এর পর জার্মানির রাইনল্যান্ড এর আর ডাব্লিউ টি এইচ, আচেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। প্রথমে ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। আরবাকান তার শিক্ষা জীবন অতিবাহিত করেন এমন এক সময় যখন কামাল আতাতুর্ক ধর্মনিরপেক্ষতার ও জাতিয়তাবাদের নামে তুরুস্ককে ধর্মহিন করার সমস্ত ব্যবস্থা নিয়েছিলেন যার মধ্যে তুর্কি ভাষায় আযান দেয়া ও ছিল। আর তার এই কাজগুলির প্রধান লক্ষ ছিল তৎকালিন ছাত্র ও যুবক শ্রেনী। এর মাঝে শিক্ষা লাভ করেও আরবাকান হয়ে উঠেন অনন্য। ১৯৬৫ সালে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন আরবাকান। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত থাকার সময় তিনি কয়েকটি গবেষনা ও ডিজাইন এর কাজ করেন যার মধ্যে জার্মান ট্যাংক লেপার্ড ১ অন্যতম। নাজমুদ্দিন আরবাকান এই ট্যাংক ডিজাইন প্রকল্পের প্রধান ছিলেন এবং এই ট্যাংক এবং এর উপর ভিত্তি করে তৈরি ট্যাংক লেপার্ড ২ এখনও জার্মানি, তুরুস্ক সহ ইউরোপিয় দেশগুলির সেনা বাহিনীতে ব্যবহৃত প্রধান ট্যাংক। ১৯৬৯ সালে আরবাকান বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন এবং এবং একই বছর তুরুস্কের ঐতিহাসিক নগরী কুনিয়া থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এসময় তিনি প্রকাশ করেন একটি ম্যানিফেষ্টো, ”মিল্লি গুরুস” বা জাতিয় দৃষ্টি নামে। এই নামের সংগঠন ও গড়ে তোলেন তিনি যা পরবর্তিতে রাজনৈতিক দলে পরিনিত হয়। ১৯৭২ সালে ”মিল্লি সালামত” বা ”ন্যাশনাল স্যালভেশন পার্টি” নামে আরেকটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন আরবাকান। তুরুস্কের আইনগত কারনে সরাসরি ইসলামের কথা বলা সম্ভব না হলেও তার দল সবসময় ইসলামের পুনরজ্জিবন এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে ধর্ম বিরোধিতার বিপক্ষে বলে আসছিল। ”মিল্লি সালামত" পার্টি ১৯৭৩ সালের তুরুস্কের জাতিয় নির্বাচনে ১২ শতাংশেরও অধিক ভোট পায়। ধর্মহিনতায় আচ্ছন্ন্ তুরুস্কে যা ছিল একটি অভাবনিয় ব্যাপার। এসময় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী রিপাবলিকান পার্টির সাথে কোয়ালিশন সরকার এ যোগ দেয় এই দল। এসময় তুরুস্ক সাইপ্রাস সংক্রান্ত একটি সমস্যার মোকাবেলা সফলভাবে করতে সমর্থ হয়। ১৯৮০ সালে তুরুস্কে আবার সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে এবং আরবাকান এবং তার দল কে তুরুস্কে রাজনিতীতে নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। ১৯৮৭ সালে আরবাকানের নেতৃত্বে গঠিত হয় রিফাহ পার্টি বা ওয়েলফেয়ার পার্টি ১৯৯০ সালের নির্বাচনে এই দল প্রচুর ভোট লাভ করে এবং প্রধান বিরোধি দল হয়। ১৯৯৫ সালে প্রায় ২২ শতাশং ভোট লাভ করে ওয়েলফেয়ার পার্টি এবং একক সংখ্যাগরিষ্ঠ না হলেও পার্লামেন্টে সর্ববৃহত রাজনৈতিক দলের মর্যাদা পায়। ১৯৯৬ সালে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয় এবং এর প্রধান মন্ত্রি হন নাজমু্িদ্দন আরবাকান। তিনিই আধূনিক তুরুস্কের প্রথম প্রধানমন্ত্রি যিনি কখনও প্রকাশ্যে ইসলাম বিরোধিতা করেননি । প্রধান মন্ত্রি হিেসবে তিনি আরব রাষ্ট্র সমূহ এবং ফিলিস্তিনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করেন। তার উদ্যোগে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালেয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া,ইরান,নাইজেরিয়া,মিসর ও তুরুস্ককে নিয়ে একটি জোট গঠিত হয় ডি-৮ বা ডেভেলপিং ৮ নামে। এই জোট প্রতিষ্ঠার পেছনে তার মুল উদ্দেশ্য ছিল যে কয়েকটি মুসলিম দেশ শিল্পায়ন,প্রযুক্তি,দক্ষ জনশক্তি এবং গনতন্ত্রের দিক দিয়ে এগিয়ে তাদের পরস্পরের সহযোগিতা, বিশেষত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ও বানিজ্য বৃদ্ধি করা। উল্লেখ্য এই সময় তুরুস্কের প্রেসিডেন্ট সুলায়মান ডেমিরেল বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। কিন্তু তার এই উদ্যোগ তুরুস্কের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী সেনাবাহিনী ও তথাকথিত সাংবিধানিক আদালতের পছন্দ হয়নি। সামরিক বাহিনী প্রধান উদ্যোগ নিয়ে সেসময় প্রধান দুটি বিরোধি দলের মধ্যে একটি সমঝোতা করে এবং মাসউদ ইলমাজ তুরুস্কের প্রধান মন্ত্রি হন। প্রধানমন্ত্রির পদ থেকে অবসর নেয়ার পর তার দল ওয়েলফেয়ার পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয় এবং তাকেও তুরুস্কের রাজনিতিতে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর ওয়েলফেয়ার পার্টির সদস্যরা গঠন করেন "ভার্চু পার্টি" নামে আরেকটি রাজনৈতিক দল। ভার্চু পার্টি পরবর্তি সংসদ নির্বাচনে বেশ ভাল ফল করে। এই পার্টি থেকেই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মার্ভ কাভাকচি যিনি মাথায় কাপর দিয়ে তরুস্কের সংসদে প্রবেশের অপরাধে সংসদ সদস্য পদ হারান এবং পরে দেশ থেকে নির্বাসিত হতে বাধ্য হন। ২০০১ সালে তরুস্কের সাংবিধানিক আদালত ভার্চূ পার্টিকেও নিষিদ্ধ করে। এরপর ভার্চু পার্টির সদস্য রা দুই ভাগ হয়ে যান। ভার্চু পার্টিে নেতৃত্বে থাকা সদস্যরা গঠন করেন ফেলিসিটি পার্টি এবং অপেক্ষাকৃত তরুন দল গঠন করে জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি। প্রত্যক্ষ রাজনিতিতে নিষিদ্ধ হলেও ভার্চু পার্টি ও ফেলিসিটি পার্টির শুরু থেকেই এই দলের তাত্বিক গুরুর স্থানে ছিলেন তিনি। তার উপর নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হলে তিনি ফেলিসিটি পার্টিতে যোগ দেন। কিন্তু একসময় তার অনুসারি তরুনদের গঠিত জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি নির্বাচনে এগিয়ে যায়। ২০০৭ সালের নির্বাচনে এই পার্টি ৪৬ শতাংশ ভোট পায় যা তরুস্কের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। নাজমুদ্দিন আরবাকান এই দলের সাথে জড়িত না থাকলেও এই দলের নেতৃবৃন্দ তার হাতেই গড়া এবং তারা তাকে শ্রদ্ধা করেন। তুরুস্কে বর্তমানে যে সংস্কার হচ্ছে এবং সামরিক বাহিনীর আধিপত্য কমিয়ে প্রকৃত গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও ইসলাম পুনপৃতিষ্ঠিত হচ্ছে সে জন্য আরবাকানের অবদান অপরিসীম। নাজমুদ্দিন আরবাকান সম্পুর্ন রুপে ইসলামি বিরোধি পরিবেশে শিক্ষা লাভ করেও স্রোতের বিপরিতে নিজের ঐতিহ্য এবং ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন হন। আরবাকান তার রাজনিতি কেবলমাত্র কথায় আর রাজনিতির ময়দানে সীমাবদ্ধ না রেখে কফি হাউজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছেন। অর্থনৈতিক স্বাধিনতা এবং প্রযুক্তির উন্মেষযে প্রকৃত স্বাধিনাতার জন্য অত্যন্ত জরুরি তা প্রকেীশলি আরবাকান ভালভাবে জানতেন। ডি-৮ গঠনের মধ্যে দিয়ে তার মুসলিম বিশ্বের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ইচ্ছা বোঝা যায়।

সম্পুর্ন বৈরি পরিবেশে থেকেও কোন রুপ সংঘাতে না গিয়েও কিভাবে ধৈর্য ও কেীশল অবলম্বন করে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় তা আরবকান আমাদের দেখিয়ে গেলেন। গ্রীক উপকথার ফিনিক্স পাখির মত যতবার তাকে ধ্বংশ করা হয়েছে ছাই থেকে পুনরায় তিনি ফিরে এসেছেন আর বিজয়ি হয়েছেন।

আমরা সবাই তার রুহ এর মাগফিরাত কামনা করছি।

বিঃদ্রঃ তুরুস্কের নির্বাচন ব্যবস্থা আমাদের থেকে ভিন্ন। সেখানা ভোটাররা প্রার্থিকে নয় বরং রাজনৈতিক দল সমূহকে ভোট দেয়। প্রাপ্ত ভোটের হার অনুসারে দলগুলি পার্লামেন্টে আসন লাভ করে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন