বুধবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২

বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও সাহারার ইতিকথা।

সাহারা গ্রুপ বাংলাদেশে আবাসন খাতে বিনিয়োগ করার জন্য চুক্তি সাক্ষর করেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতি পুর্ন দেশ হওয়ার কারনে এখানে জমির মুল্য অনেক (সিঙ্গাপুর বা হংকং তত্বগতভাবে আরো বেশি ঘনবসতি পুর্ন হলেও সেগুলি ক্ষুদ্রাকৃতি সিটি স্টেট)। সেখানে সাহারা গ্রুপকে রাজধানির আশেপাশে একলক্ষ একর জমি দেওয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে রাজউক। অর্থাত এই জমি হুকুম দখল আইন প্রয়োগ করে সামান্য ক্ষতিপুরন দিয়ে বর্তমান মালিক দের থেকে নেয়া হবে এবং তা সল্পমুল্যে সাহারার কাছে স্থানান্তর করা হবে। এই ক্ষতিপুরন ও আবার দেওয়া হবে জমির মালিকদের আবেদনের ভিত্তিতে। মানে আপনি যদি নিজে জমির মালিক হন তবে আপনাকে দেীড়াদেীড়ি করে এবং প্রচুর ঘুষ দিয়ে নিজের উত্তরাধিকার কিংবা ক্রয় সুত্রে প্রাপ্ত জমির অনুপযুক্ত মুল্যটি আদায় করতে হবে। বাংলাদেশে মাথাপিছূ জমির পরিমান মাত্র .২৫ একর। অর্থাত এই পরিমার জমি সাহারাকে দেওয়ার জন্য বাস্তুহারা করতে হবে কমপক্ষে ৪ লক্ষ লোক। আর এই এলাকা ডেভেলপ করে সাহারা উচ্চমুল্যে এই জমি পুনঃবিক্রিয় করবে তারা সন্দেহাতিতভাবে হবে উচ্চবিত্ত ( অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটি ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলছি, যেখানে আমাদের দেশে ৭-৮ সদস্যের একটি পরিবার ৬০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট এ বসবাস করেন সেখানে একজন ব্যবসায়ির বেডরুমের আয়তন দেখেছি ১৪০০ বর্গফুট)। ইতঃমধ্যে আমাদের দেশের আবাসন ডেভেলপমেন্ট সেক্টর ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সেক্টর থেকে এই ব্যাপারে বিভিন্ন আপত্তি উঠেছে।
এই সাহারাগ্রুপ এবং এর মালিক সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দিচ্ছি। সাহারার ইতিহাস শূরু ১৯৭৮ সালে। বর্তমানের সাহারা ম্যানেজিং ওয়ার্কার( সাহারাগ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদবির বদলে এই পদবি ব্যবহার করে) সাহারাশ্রী সুব্রত রায় কিন্তু এর প্রতিষ্ঠাতা নন। এটি ছিল একটি ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রতিষ্ঠান এবং মার্কেটিং এর কাজ ও করত। অন্যদিক থেকে বলতে গেলে এটি আজকের এমএলএম প্রতিষ্ঠানগুলির পুর্বসুরি। তবে এই প্রতিষ্ঠান ভারতে ক্ষুদ্র সঞ্চয় ও ঋনদান সংস্থা হিসেবে লাইসেন্স প্রাপ্ত ছিল। সুব্রত রায় ১৯৭৮ সালে এই সংস্থার যখন একবারে শৈশব তখন সেখানে এজন্ট হিসেবে যোগদেন। সুব্রত রায় এর জন্ম ও বসবাস বিহারের গোরখপুরে। প্রকৃত বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলায়। পিতা ছিলেন সুগার মিলের উচ্চপদস্থ ইঞ্জিনিয়ার। কলকাতা,বেনারস বিভিন্ন জায়গায় স্কুল জীবন পার করেন। গোরখপুর পলিটেকনিক থেকে মেকানিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডিপ্লোমা করার পর বিভিন্ন প্রকার ব্যবসার চেষ্টা করেন কিন্তু কখনও চাকরি করেননি। ১৯৭৮ সালে পিতার মৃত্যুর পর কিছূটা সমস্যায় পরেন তিনি। এই সময় তার মা তৎকালিন সাহারা প্রতিষ্ঠানে মাসিক ভিত্তিতে কিছূ অর্থ সঞ্চয় করতেন সে সুত্রে এই প্রতিষ্ঠানের সাথে পরিচিত হন তিনি। তিনি স্থানিয় ব্যাক্তি হওয়ায় এজন্ট হিসেবে বেশ সাফল্য অর্জন করেন এবং ধিরে ধিরে এই প্রতিষ্ঠানের একক নিয়ন্ত্রক এর ভুমিকায় উঠে আসেন। তিনি প্রাপ্ত সঞ্চয় শুধুমাত্র সরকারী বন্ড বা সিকিউরিটিতে বিনিয়োগ এবং ঋনদানের বদলে সঞ্চিত টাকা সংস্থার নিজস্ব উদ্যোগে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন। এই উদ্যোগ থেকে প্রথমেই শুরু হয় সাহারার আবাসন ব্যবসা। অসংখ্য ক্ষুদ্র সঞ্চয় একত্র করে এই প্রতিষ্ঠান বৃহত পুঁজি গঠন করতে সমর্থ হয়। এরপর এই প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করে মিডিয়া,টুরিজম, সাস্থ সেবা , হোটেল ,পরিবহন,তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি খাতে। এই প্রতিষ্ঠানের মূল ব্যবসা ক্ষুদ্র সঞ্চয় ও বিনিয়োগ ও বর্তমানে চালু আছে। সেই সঙ্গে এই সঞ্চয় এর বিপরিতে নিত্য প্রয়োজনিয় সামগ্রি সরবরাহের ব্যবসাও এর অন্যতম লাভজনক ব্যবসা। এছাড়াও খাদ্য সরবরাহকারী চেইন শপ ”কিউ শপ” এর মালিক ও এই গোষ্ঠি। সাহারা এয়ার লাইন্স নামে বিমান পরিবহন সংস্থাও চালু করা হয়েছিল কিন্তু লাভ করতে না পারায় তা জেট এয়ারওয়েজ Í কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের মার্কেট ক্যাপিটাল ২৫ বিলিয়ন ডলার এবং বাৎসরিক আয় প্রায় ৭৩ হাজার কোটি রুপি। এছাড়া আইপিএল এর পুনে ওয়ারিয়র্স এর মালিক সাহারা। রেসিং কার সহ ক্রিড়া ক্ষেত্রেও এর প্রচুর বিনিয়োগ এবং স্পনসর আছে।
অন্যান্য ব্যবসায়িক গ্রুপের সাথে এর কিছূ মেীলিক পার্থক্য আছে। যেমন এর কর্মিরা শুধু কর্মচারি নন বরং প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হোল্ডার ও হয়ে থাকেন। লাভের একটি বড় অংশই কর্মিকল্যানে ব্যায় হযে থাকে। প্রধান কর্মচারিদের সাথে নিন্মপদস্থ কর্মচারিদের বেতন বা পদমর্যাদায় পার্থক্য যাই থাকুকনা কেন প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য সুযোগসুবিধা সমান পান। কর্পোরেট সংস্থাগুলিতে যেখানে বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তার জন্য বিভিন্ন মানের ক্যান্টিনও থাকে সেখানে সাহারার প্রধান সহ সকলেই সংষ্থার হেড অফিসে একই ক্যান্টিনে একই খাবার গ্রহন করেন। প্রতিস্ঠানের প্রধান কর্মচারিরা ডিরেক্টের বা ম্যানেজার এর বদলে ম্যানেজিং ওয়ার্কার বলে পরিচিত। আরেকটি জিনিস এই গ্রুপটিতে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য যেখানে ভারতের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলি উচ্চবেতনে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ম্যনেজমেন্ট এর মত বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানথেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত সদ্য গ্রাজুয়েট দেরকে নিযুক্ত করে সেখানে এই প্রতিষ্ঠান এর বেশিরভাগ কর্মকর্তাই সাধারন কলেজ বা অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত। এখানে ডিগ্রির চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া কাজের যোগ্যতার। বর্তমানে সাহারা ভারতে বেসরকারী সর্ববৃহত মানব সম্পদের অধিকারি এবং সমগ্র ভারতে রেলওয়ের পর বৃহত্তম এমপ্লয়ার। যদিও এদের একটি বড় অংশই স্থায়ি কর্মচারি নন। বরং কমিশনের ভিত্তিতে আমানত সংগ্রহ করেন এবং নিত্তপ্রয়োজনিয় দ্রব্যাদি ক্রেতার কাছে সরবরাহ করেন। তবে তারাও ইন্সুরেন্স,চিকিৎসা সহ অন্যান্য সুবিধা পেয়ে থাকেন। সাহারার নামটি নিয়েও বেশ হাস্যকর একটি ব্যাপার আছে। প্রকৃত পক্ষে এই প্রতিষ্ঠান টির নাম ছিল সহারা অর্থাত হিন্দি ভাষায় সাহাজ্য। কিন্তু ইংরেজি বানান ও উচ্চরনে সাহারা হয়ে গেছে। মোটের উপর একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে সাহারা বেশ ভিন্নতর। এর প্রধান সুব্রত রায় ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নিজস্ব নিতি অনুসরন করে চলেন এবং তিনি যথেষ্ট সফল।

ব্যাসায়িক ক্ষেত্রে সফল ও ভাল প্রতিষ্ঠান হলেও বাংলাদেশে সাহারার বিনিয়োগ বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হবে কিনা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের কারন আছে। সাহারা আবাসন খাতে প্রধানত ব্যবসা করে থাকে ভারতের মহারাষ্ট্র ও উত্তর প্রদেশে। জনবহুল হলেও এই দুটি রাজ্যে প্রাকৃতিক কারনে অনেক জমি অব্যবহত ছিল। সাহারা বিশাল বিনিয়োগ এর মাধ্যমে এই জমি কে ভরাট ও পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা করে তাকে ব্যবহার উপোযোগি করেছে। সেখানে বাংলা দেশে একটি নতুন শহর প্রতিষ্ঠার জন্য এক লক্ষ একর জমি ঢাকা নগরীর আশে পাশে রাজউক এর আওতার মধ্যে এক সাথে পাওয়ার চিন্তা করাই অসম্ভব। এই এলাকার মধ্যে ইতঃমধ্যেই দেশিয় প্রতিষ্ঠানগুলি প্রচুর বিনিয়োগ করেছে এবং এখানে তাজা শাকসবজি এবং দুধ ডিম সহ বিভিন্ন কৃষি পন্যের খামার ও গড়ে উঠেছে। সুতারাং এই পরিমান জমি যদি সল্পমুল্যে সাহারাকে দেয়া হয় তাহলেকৃষি ক্ষেত্রেও বিরাট ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সুতারাং এই বিনিয়োগ কতটুক দেশের স্বার্থে হবে তানিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। সাহারা গ্রুপ যদিও অনেক বেশি জনকল্যানমুলক তথাপি তারা ব্যবসা করার উদ্যেশ্যেই আসবে এবং এ ব্যাপারে তাদেরও কোন লুকোচুরি নাই। বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে সাহারা গ্রুপ কে বিনিয়োগ করার সুযোগ দিয়ে যে পরিমান কর্মসংস্থান হবে সেই সুযোগসুবিধা গুলি যদি দেশিয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে দেয়া হয় তা হলে সেগুলি অনেক বেশি কর্মসংষ্তান সৃস্টি করতে পারবে। আর নিশ্চিত ভাবে বলা যায় সাহারা গ্রুপ তাদের প্রকল্পে কখনই অর্ধেক এর বেশি কর্মচারি এদেশ থেকে নিয়োগ করবে না এবং নিশ্চিতভাবেই উচ্চ পদে নিয়োগ করবেনা। অন্য দিকে আবাসন সংশ্লিষ্ট শিল্প গুলি যথা ইট,সিমেন্ট,রড,রং,এলুমিনিয়াম, টাইলস ইত্যাদির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ এখন অনেক এগিয়ে আছে। সেখানে সাহারা নিম্চিতভাবেই তাদের নিজস্ব কারখানায় তৈরি এই জিনিসগুলি ব্যভহার করবে যেখানে দেশিও প্রতিষ্ঠানগুলি দেশের জিনিস ব্যবহার করে। সব মিলিয়ে বর্তমান শর্তে সাহারার বিনিয়োগ প্রকৃত পক্ষে কতটুক লাভ জনক হবে তা চিন্তার বিষয়।

* সাহারা ও সুব্রত রায় সংক্রান্ত তথ্যগুলি ইন্টারনেট এবং ভারতের বিশিষ্ট সাহিত্যিক শংকর রচিত
" বাঙ্গালীর বিত্ত সাধনা সাহারার ইতিকথা" বইটি থেকে নেয়া হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন