বুধবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২

হায় ফুটবলের উন্নতি।

সালাহউদ্দিন যখন বাফুফের সভাপতি নির্বাচিত হলেন তখন তখন বাংলাদেশের সকল ক্রিড়াপ্রেমি জনসাধারনই দল-মত নির্বিশেষে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিল। কারন এর আগে সবসময় বাফুফের সভাপতি পদে যারা এসেছেন তারা সবাই ছিলেন নামমাত্র ক্রিড়া সংগঠক। রাজনৈতিক প্রভাব বজায় রাখা বা অন্যান্য স্বার্থে যারা ক্রিড়াঙ্গনের সাথে সামান্য সম্পর্ক বজায় রাখতেন। কিন্ত সালাউদ্দিন বাংলা দেশের ফুটবলের শ্রেষ্ঠ স্ট্রাইকার ছিলেন। খুব ছোটকালে দেখা তার খেলার বেশি কিছু মনে না থাকলেও জাতিয় দল এবং বিভিন্ন ক্লাবের কোচ হিসেবে তার সাফল্য আমারা দেখেছি। ক্রিড়াপ্রেমি বাংলাদেশের জনগন ভেবেছিল ফুটবলের সেই সুদিন আবার ফিরে আসবে। যখন আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ দেখার জন্য বেলা তিনটার মধ্যে দেশের সব শহরের রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেত। এখন অনেকে হয়তোবা আবাহনির নীল-হলুদ এবং মোহামেডানের সাদা-কালো পতাকা চিনেননা। কিন্তু তখন প্রিমিয়ার লিগ চলা কালে এখন যেমন বিম্বকাপের সময় আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল এর পতাকা উড়ে সেরকম আবাহনী-মোহামেডানের পতাকা উড়ত মোড়ে মোড়ে। নব্বই এর দশক থেকে শুরু হয় আমাদের ফুটবলের অধোগতি। সালাউদ্দিন,কায়সার,আসলাম,সাব্বির,রুমি,আলফাজ দের উত্তরসূরি হিসেবে সেই মানের কোন ফুটবলার আর আসেনি। যদিও এর মধ্যেই ২০০৩ এর সাফ ফুটবলের মত কয়েকটি সাফল্য এসেছে। কিন্তু জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে ফুটবলের মান নেমে গেছ অনেক। ক্রিকেটের তুলনামুলক ভাল সাফল্য এবং ডিস এর কল্যানে আন্তর্জাতিক ফুটবল এর জনপ্রিয়তা আরো কমিয়ে দিয়েছে ফুটবলের জনপ্রিয়তা।
ফুটবলের এই পতন এর মধ্যেই আবার যুক্ত হয়েছে রাজনিতি এবং পাতানো খেলা। বাংলাদেশ লিগে সবসময় প্রিমিয়ার লিগের কয়েকটি দল এবং দেশের বিভাগিয় লিগগুলির সেরা দলগুলি নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ২০০৭ সাল থেকে। প্রথম তিনটি লিগে চ্যাম্পিয়ন হয় ঢাকা আবাহনী। এবার হটাত করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ঢাকার প্রথম বিভাগ লিগ থেকে একটি দল কে সুযোগ দেয়ার। প্রায় ৪০ বছরের কাছাকাছি দেশের ক্রিড়াঙ্গনে মধ্যম সারির ক্লাব বলে পরিচিত ধানমন্ডি ক্লাব হঠাত করেই তার নাম পরিবর্তন করে হয়ে যায় "শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব"। আর এই নামের বদেীলতে রানারআপ হয়েও বাংলাদেশ লিগে খেলার যোগ্যতা অর্যন করে তারা। শেষ পর্যন্ত প্রিমিয়ার লিগ এবং আঞ্চলিক লিগের দলগুলিকে পরাজিত করে প্রথমবার খেলেই প্রফেশনাল লিগ চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করে তারা। কিন্তু এই লিগে তাদের কোয়ালিফাই করা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ তেনমি তার চ্যাম্পিয়নশিপও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে পাতানো খেলার অভিযোগে। বিশেষ করে রহমতগঞ্জ এর সাথে তাদের খেলাটি পাতানোর অভিযোগে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। রহমতগঞ্জ এদেশের ফুটবলের পরিচিত নাম। প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন না হলেও কয়েকবারই তৃত্বিয়-চতুর্থ স্থানে ছিল রহমতগঞ্জ। কিন্তু এভাবে তার একটি নতুন দলের কাছে সন্মান বিসর্জন ধেয়ার পিছনে কি ছিল? শুধুই টাকা, না তার সাথে আরো কিছু। এবারের বাংলাদেশ লিগের কয়েকটি খেলাই পাতানোর অভিযোগ থাকলেও অন্য দলগুলির চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত তদন্ত কমিটি গঠিত হয় শুধু রহমতগঞ্জ-শেখ জামাল্ ম্যাচটির জন্য। আজকে সেই কমিটি রিপোর্ট দিয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে ম্যাচটি সমঝোতার মাধ্যমে হয়েছে এবং এর জন্য ক্লাব দ্বয় এবং সংশ্লিষ্ট খেলোয়ারদের জরিমানার সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু ম্যাচ পাতানো আর সমঝোতার মধ্যে পার্থক্য কোথায়? বাংলাদেশ লিগের বাইলজ অনুযায়ি কোন দলের বিপক্ষে ম্যাচ পাতানোর অভিযোগ প্রমানিত হলে তার স্থান অবনমনের বিধান আছে। কি কারনে তদন্ত রিপোর্টে কথার মারপ্যচে উদ্ধার পেয়ে যাচ্ছে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব? দেশের ফুটবলে পাতানো খেলা নতুন কিছু না হলেও এই ভাবে মানুষের চোখে ধুলো দেয়ার চেষ্টার কারন কি? শুধু নাম আর পিছনের শক্তির দাপটেই কি প্রথম বার খেলতে নেমেই তার থেকে র্যাংকিং এ এগিয়ে থাকা নয়টি দলকে অতিক্রম করে বাংলাদেশ লিগ চ্যাম্পিয়ন হলো এই ক্লাবটি। আর যদি ক্লাব দ্বয় কোন অপরাধ না করেই থাকে তাহলে জরিমানার সুপারিশ কেন?
ফুটবল নিয়ে দেশের ক্রিড়াপ্রেমি জনগন যে সপ্ন আবার দেখছিল তা কি স্রেফ কিছু সুযোগ সন্ধানির জন্য ভেষ্তে যাবে। তাহলে কি সেই সুযোগ সন্ধানিরা যার নাম ব্যানার হিসেবে ব্যবহার করছে তার নামের মুল্য এদেশের ফুটবলের ভবিষ্যতের থেকে বেশি।

এই পৃথিবী একবার পায় তারে। সৈয়দ আলি আহসান।

আজকে ২৫ জুলাই কবি,প্রাবন্ধিক,শিক্ষাবিদ,গবেষক,সাহিত্যিক,জাতিয় অধ্যাপক সর্বোপরি আমাদের জাতিয় জিবনের অভিভাবক সৈয়দ আলি আহসান এর নবম মৃত্যুবার্ষিকী। নয়টি বছর তার ইন্তেকালের পর পার হয়ে গেছে কিন্তু তার অভাব এখনও কোন অংশেই পুরন হয়নি। আর বর্তমান সময়ে তার অভাব আমরা অনুভব করছি আরো বেশি।
মরহুম আবুল মনসুর আহমদ মাওলানা আকরাম খানের ইন্তেকালে লিখেছিলেন,”দেশ হারাইল একটি আলোক স্তম্ভ,দেশবাসি হারাইল বাড়ীর মুরুব্বি,সাহিত্যিক সাংবাদিকরা হারাইলেন উপদেষ্টা,রাজনিতিবিদরা হারাইলেন পথের দিশারি,আলেম সম্প্রদায় হারাইলেন একজন অনুপ্রেরনা দাতা”,ঠিক এই কথাগুলি প্রযোজ্য সৈয়দ আলি আহসানের জন্যও। তিনি ইন্তেকাল করেছেন তিরাশি বছর বয়সে। আমাদের গড় আয়ুর হিসেবে দির্ঘ জিবনের অধিকারি হয়েছিলেন। আর এই দির্ঘ জিবনে তিনি এই বাংলাদেশ ও জাতি এবং মানবতার জন্যই কাজ করে গেছেন। বহুমুখি এই প্রতিভা তার মৃত্যর দিন পর্যন্ত কাজ করেঘেছেন,লিখে গেছেন অসংখ্য গবেষনা,প্রবন্ধ,গল্প,উপন্যাস,স্মৃতি কথা এবং অবশ্যই কবিতা। নিজেকে তিনি কবি বলেই পরিচয় দিতেন প্রায়ই যদিও তার প্রধান খ্যাতি ছিল শিক্ষাবিদ হিসেবেই।
সৈয়দ আলি আহসানের জন্ম ১৯২২ সালে ২৬ শে মার্চ মাগুরা জেলার আলোকদিয়া গ্রামে। এই ক্ষেত্রে তার সাথে তার একজন প্রিয় সাহিত্যিক ও বন্ধু ভারতিয় লেখক খুশবন্ত সিং এর মিল আছে। উভয়ের জন্মদিনই পরবর্তিতে স্ব স্ব দেশের স্বাধিনতা দিবসে পরিনিত হয়। গ্রামে তার পড়াশোনার শুরু হয়। পরবর্তিতে তার শিক্ষাবিভাগের কর্মরত পিতার সাথে ঢাকায় স্থায়ি ভাবে চলে আসেন এংব আর্মানিটোলা স্কুলে ভর্তি হন। তিনি তার পরিবারের জেষ্ঠো পুত্র। আর্মানিটোলা স্কুল থেকে,মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরিক্ষায় উত্তির্ন হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন তিনি এবং এখান থেকে ১৯৪৪ সালে মাষ্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি এরপর প্রথমে যোগ দেন তৎকালনি অলইন্ডিয়া রেডিওতে। রেডিওর প্রোগ্রাম এসিষ্টেন্ট হিসেবে যোগ দেন কলকাতা কেন্দ্রে।তবে এর আগে তিনি সল্প সময় হুগলি কলেজে অধ্যাপনা করেছিলেন। রেডিওতে তার যোগদানের পর তখন রেডিওতে কর্মরত তার সহকর্মি সাহিত্যিক,অভিনেতা ও চলচ্চিত্র পরিচালক নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ চট্যোপাধ্যায় এর সহযোগিতায় তিনি তৎকালিন রেডিওতে অবহেলিত মুসলিম বুদ্ধিজিবি এবং শিল্পিদেরকে অনুষ্ঠানের সুযোগ করে দেন। যা রেডিওতে কর্মরত অনেকের কায়েমি স্বার্থকে ক্ষুন্ন করে। তাকে অল ইন্ডিয়া রেডিওর ঢাকা কেন্দ্রে বদলি করা হয়। ১৯৪৭ স্বাধিন হয় পাকিস্তান। ১৯৪৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ইংরেজি বিভাগের ছাত্র হলেও বাংলা সাহিত্য ও কবিতায় ততদিনে তার খ্যাতি বিস্তৃত হওয়ায় তিনি এই সুযোগ পান। তিনি লেখালেখি ও কবিতা রচনা শুরু করেছিলেন তার স্কুল জিবনেই। তবে কলকাতায় অবস্থান কালেই সাহিত্যিক হিসেবে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন। ১৯৫৩ সালে তিনি করাচি বিশ্ববিদ্যারয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। এখানে কর্মরত থাকার সময় তিনি বাংলা ভাষা সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে পরিচিত করে তুলার জন্য অনেক অবদান রাখেন। ১৯৬০ সালে তিনি বাংলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে দ্বায়িত্ব গ্রহন করেন। তার সময়ে বাংলা একাডেমি অত্যন্ত গতিশিল একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠে । কিন্তু তার স্বাধিনচেতা মানসিকতার কারনে তৎকালিন গভর্নর মুনায়েম খানের সাথে তার সংঘাতের সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত তাকে বাংলা একাডেমি ত্যাগ করতে হয়। তিনি এরপর অধ্যাপক হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগদেন। তার সাহিত্য ও পারিবারিক জিবনে এই সময়টি বিশেষ উল্লেখযোগ্য বলে তিনি বিভিন্ন লেখায় উল্লেখ করেছেন। এই সময় পাকিস্তান রাষ্ট্রটির উপর তিনি আস্থা হারিয়ে ফেলেন। ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ এর পর তিনি এপ্রিল মাসের প্রথমেই রামগড় দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে বেতার সম্প্রচার এবং বিশ্বের সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজিবি অঙ্গনে বাংলাদেশের স্বাধিনতার প্রতি সমর্থন অর্জনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। ১৯৭২ সালে তাকে জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত করা হয়।নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয় টি গড়ে তুলতে তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তার ব্যাক্তিত্ব তাকে আবারও সরকারের কর্তাব্যাক্তিদের বিরাগ ভাজন করে তুলে। সরকারি দল এবং এর ছাত্র সংগঠনের কাছে আত্মসমর্পন না করার অনমনিয়তার জন্য তিনি তাদের চক্ষুশুল হয়ে উঠেন। শেষ পর্যন্ত তাকে পদত্যাগ করতে হয়। তৎকালিন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমান তার প্রতি শ্রদ্ধা সত্বেয় তাকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেন। এর পর তিনি আবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যায়ে যোগ দেন ।১৯৭৫ সালের শেষ দিকে তিনি রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। ১৯৭৭ সালে পুর্ন মন্ত্রির পদমর্যাদায় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা হিসেবে যোগদেন। তার দায়িত্ব ছিল শিক্ষা,ক্রিড়া,সংস্কৃতি ও ধর্ম বিভাগের। এই পদে থেকে তিনি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তনের উদ্যোগ নেন এবং অনেক কাজ সম্পন্ন করতেও সক্ষম হন। এর মধ্যে দেশের কারিগরি শিক্ষা ও পলিটেকনিক ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গুলির উন্নয়নে তার অবদান বিশেষ উল্লেখযোগ্য । দেশের ক্রিড়ার উন্নয়নে ও তিনি অনেক কাজ করেন। এসময় ই বাংলাদেশ আইসিসির সহযোগি সদস্য পদ লাভ করে এবং বক্সার মুহাম্মদ আলি বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার এই বহুমুখি কর্মকান্ড আবার কায়েমি স্বার্থবাদি শক্তির জন্য বিপদ হয়ে দেখা দেয় এবং শেষ পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব থেকে সরে আসেন। এরপর দির্ঘদিন তিনি কোন নিয়মিত কাজ করেননি। মাঝখানে কিছুদিন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। ১৯৮৯ সালে তিনি জাতিয় অধ্যাপক হন। শেষ বয়সে তার ছোটভাই সৈয়দ আলি আশরাফ প্রতিষ্ঠিত দারুল এহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন।
সৈয়দ আলি আহসান তার দির্ঘ জিবনে আমাদের দেশ ও জাতির জন্য অনেক কাজ করে গেছেন। জিবনের শেষ দিনগুলিতেও তার লেখার বিরাম ছিলনা। অসংখ্য প্রবন্ধ ও স্মৃতিকথায় তিনি সম্বৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যকে। আর কবি হিসেবে তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন নতুন দিগন্তের সৃষ্টি কারি ।
২০০২ সালের ২৫ শে জুলাই তিনি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন।

আজকে তার নবম মৃত্য বার্ষিকিতে দেশের পত্রিকা ও ব্লগের নিরবতা দেখে ভাবছি এই দেশে কি তার মতো আর কেউ জন্ম গ্রহন করবে কিনা।

ঈদ-উল -আযহা। কুরবানী এবং আমাদের দেশের মানুষ।

ঈদ মুবারক,ঈদ মুবারক ঈদ মুবারক হো
রাহেলিল্লাহকে বিলিয়ে দিয়ে কে হলো শহিদ।


ইসলাম এর অনুসারিদের জন্য যে দুটি উৎসব এর দিন নির্ধারিত আছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে ঈদ-উল-আযহা। এই ঈদের অন্যতম অনুসঙ্গ পশু কুরবানি। ঈদ উল আযহার দিন সামর্থবান সকল মুসলিম নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের নামে হালাল পশু কুরবানি করেন। এই কুরবানি কৃত পশুর গোস্ত নিজে পরিবারের সাথে গ্রহন করেন এবং এর একটি বড় অংশ দরিদ্র মানুষদেরকে দেন। এই দান দয়া নয় বরং কুরবানির গোস্তে বঞ্চিতদের অধিকার।

বাংলাদেশে এবং বিশ্বে অনেকেই আছেন যারা এই কুরবানির বিরোধিতা করেন। কারো যুক্তি তথাকথিত পশু অধিকার নিয়ে আর বাংলাদেশে প্রধান যুক্তি অর্থনিতি নিয়ে। বাংলাদেশে প্রধানত যে পশু কুরবানি হয় তা হলো গরু। এই নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেন যে আমাদের কৃষি কাজে যেহেতু গরু ব্যবহত হয় সেহেতু গরু কুরবানি করা কৃষি কাজে উৎপাদনের হার কমিয়ে দেয়। এই যুক্তিটি সম্পুর্ন ভুল। আমাদের দেশে অনেক যায়গায় ১৯৪৭ এর পুর্বে গরু কুরবানি করা যেতনা। অথচ কৃষি গবেষনা কাউন্সিল এর তথ্য অনুযায়ি আমাদের দেশের মোট কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে তার পর থেকে কয়েকশত গুন।

পুষ্টির ক্ষেত্রে আমাদের দেশে প্রোটিন ঘাটতির পরিমান প্রায় ৭৫ শতাংশ। অনেক দরিদ্র আছেন সারা বছরের মধ্যে শুধু এই দিন ভাল ভাবে গোস্ত খেতে পারেন। অনেকে এই সময় যা গোস্ত পান তা দিয়ে পরবর্তি দুই-তিন মাসের গোস্তের চাহিদা পুরন করেন।
ঈদুল আযহা উপলক্ষে দেশের অর্থনিতিতে একটি বিশাল অর্থ সার্কুলেশন হয় যা আমাদের মত একটি দেশের উন্নয়নের জন্য অতি প্রয়োজনিয়। এই কাজটি কিন্তু চলে সারা বছর ধরেই। আমাদের দেশে যে পরিমান গরু কুরবানি হয় তার একটি অংশ ভারত থেকে বৈধ-অবৈধ পথে আমদানি হয়। ছাগল অবশ্য প্রধানত দেশেই উৎপাদিত হয়। এই আমদানির হার আরো বেশি ছিল কিন্তু বর্তমানে গ্রামীন উন্নয়নে গরু মোটাতাজাকরন সহ বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে এই আমদানির হার অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। ঈদ-উল-আযহা এর জন্য পশু পালন গ্রামীন জনগনের জন্য একটি উপযুক্ত কর্মসংস্থান। বিশেষ করে ছাগল পালন এই জন্য গ্রামীন দরিদ্র জনগোষ্ঠির একটি বড় আয়ের উৎস।
ঈদ-উল আযহার জন্য এই পশু কে কুরবানির উপযুক্ত করার জন্য সরাসরি জড়িত থাকে অনেক গুলি পক্ষ যার সকলই কিছু আয়ের সুযোগ হয় এ সময়। আমরা যদি পর্যায় ক্রমে দেখি তা হলে বুঝা যাবে কিভাবে ঈদুল আযহা আমাদের অর্থনিতির উপকার করে।
১.কুরবানির জন্য পশু পালন:- কুরবানির জন্য পুর্নবয়স্ক এবং সুস্থ সবল পশু প্রয়োজন। এজন্য পশু পালনকারী তাকে উপযুক্ত খাদ্য খাওয়ায় এবং নিয়মিত চিকিৎসা করে। এক্ষেত্রে উপকারভোগি পক্ষগুলি হচ্ছে পশুপালনকারী, সহায়তাকারী,পশু ডাক্তার, ওষুধ বিক্রেতা এবং পশুখাদ্য বিক্রেতা।
২.কুরবানির পশু বিক্রয়ের জন্য নিয়ে যাওয়া:- কুরবানীর পশু বিক্রয়ের জন্য উপযুক্ত হাটে নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রাক-ট্রলার ইত্রাদি বাহন ব্যবহার করা হয়। ঢাকা শহরের একটি হাটেই ঈদের ছয়-সাতদিন দিনে গড়ে ১০০ট্রাক কুরবানীর পশু আসে। এক্ষেত্রে উপকারভোগি ট্রাক-ট্রলার চালক,সহকারি,মালিক। উঠানামার কাজে সাহাজ্য কারী শ্রমিক। এবং গ্রাম থেকে পশু ক্রয় করে আনার পাইকার এবং তার সহায়তা কারীরা।
৩.হাটে রাখা :-হাটে পশু রাখতে এবং বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত তার জন্য খাবার-পানি ইত্যাদি প্রয়োজন হয়। এই ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান হয় অনেকের। অন্যদিকে শহরের স্থায়ি-অস্থায়ি হাট থেকে সরকার সরাসরি ইজারা এবং ভ্যাট এর মাধ্যমে রাজস্ব পায়। উপকার ভোগি পক্ষগুলি হচ্ছে হাটের ইজারাদার এবং তার কর্মচারি, হাট সাজানর জন্য উপকরন যথা বাঁশ,শামিয়ানা লাইটিং ইত্যাদি সরবরাহকারী ,হাটে পশুখাদ্য সরবরাহকারী, গোবর সংগ্রহকারী এবং হাট পরিস্কারে নিয়োজিত কর্মচারি,ট্যাক্স ইজারা ও ভ্যাট এর মাধ্যমে সরাসরি সরকার।
৪.বাসায় আনা:- বেশিরভাগ কুরবানী দাতাই ঈদের দুই তিনদিন আগে কুরবানির পশু কিনে নেন। এই দুইতিনদিন পশুদের খাবার স্থানিয় ভাবে সরবরাহ করা হয় এবং দেখাশুনার জন্য লোক নিয়োজিত করা হয়।
৫.কুরবানির প্রস্তুতি:- কুরবানির এবং গোস্ত কাটার জন্য উপযুক্ত ছুড়ি,দা বটি যোগাড় এবং পুরোন গুলি ধার দেওয়া হয়। পশু বাধার জন্য দড়ি এবং গোম্ত কাটার জন্য পাটি ও রাখার জন্য ঝুড়ি ও পাত্র। এক্ষেত্রে সরাসরি উপকার ভোগি এই জিনিস গুলির নির্মাতা ও সরবরাহকারীরা।
৬.কুরবানীর গোস্ত ও চামড়া:- কুরবানির গোস্ত গ্রহনকারী সকল ব্যাক্তি। গোস্ত কাটার জন্য নিয়োজিত পেশাদার ও অপেশাদার কসাই,চামড়া ক্রেতা এবং কোন মাদ্রাসা বা ইয়াতিম খানায় দেয়া চামড়ার উপকারভোগি।
এই্গুলো কুরবানি দেয়ার আগে ও পরের অর্থনিতিতে অবদান ও উকারভোগিদের বিবরন। কুরবানির আরেকটি বড় অবদান হচ্ছে চামড়া শিল্প। বাংলাদেশ বর্তমানে চামড়া শিল্প থেকে বছরে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার আয় করে যার পঞ্চাশভাগ এর বেশি কাজ হয় কুরবানী উপলক্ষে। অনেক ট্যানারি আছে যারা শূধূ এই সময়ই কাজ করে। এই ৫০০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে আমদানির অংশ খুবই কম অর্থাত এই আয় পুরোপুরি মেধের অর্থনিতিতে অবদান রাখে। দেশিয় জুতা ও অন্যান্য শিল্পেও কাচামাল হিসেবে এই চামড়া ব্যবহৃত হয়।

কুরবানির ঈদ বাংলাদেশের অর্থনিতিতে কোন খারাপ প্রভাব তো ফেলেই না বরং এটি দেশের অর্থনিতি এবং কর্মসংস্থান বিশেষ করে গ্রামীন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অনেক বড় অবদান রাখে। যারা কুরবানির বিরোধিতা করেন তারা মূলত অজ্ঞতা এবং অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে করেন। দেশে অনেকই দারিদ্রের জন্য প্রয়োজনিয় প্রোটিন পায়না,সামর্থবান ব্যাক্তিরা এই দিন কুরবানি করেন এবং সেই কুরবানিকৃতপশুতে সামর্থহীনদের যে অংশ থাকে তার মাধ্যমে তারা কিছুদিনে জন্য হলেও প্রোটিন চাহিদা পুরুনের সুযোগ পান।
সুতারং কুরবানি আমাদের মত দেশের জন্য শুধু যুক্তিযুক্তই নয় উন্নয়নের জন্য অতি প্রয়োজনিয়।

আরবী মাস ও তারিখ নিয়ে জটিলতা। আজকে দশই মুহররম ঠিক।

আরবী মাস অনুযায়ি ইসলাম এর অনুসারিরা তাদের ইবাদত ও উৎসব পালন করে থাকেন। আরবী সাল গননা পদ্ধতিতে মাস একটি চান্দ্র মাস। অর্থাত চাঁেদর আবর্তনের উপর নির্ভর করে এই মাস এর প্রথম ও শেষ দিন নির্ধারন করা হয়। বিভিন্ন আলেম দের কাছ থেকে যতটুক যেনেছি। হাদিসে রমজানের রোজা সম্পর্কে বলা হয়ে চাঁদ দেখে রাখতে এবং চাঁদ দেখে রোজা ছাড়তে। আর্থাত চাক্ষুস চাঁদ দেখার উপর রমজান মাস নির্ভরশিল। কিন্তু শুধু রমজান মাস নয় অন্য মাস গননার ক্ষেত্রেও এই গ্রহনযোগ্য একাধিক মুসলিম ব্যাক্তির চাঁদ দেখার সাক্ষের উপর নির্ভর করে আরবী মাস নির্দারন করা হয়। আরবী বছর গননা করা হয় সাধারনত ৩৫৫-৩৫৬ দিনে। ঋতুর উপর এই সাল নির্ভরশিল নয়। আরবী মাসগুলি চাঁদের আবর্তনের উপর নির্ভর করে ২৯ বা ত্রিশ দিনে হয়। চাঁদের নিজস্ব কোন আলো নাই। সুর্যের আলো চাঁদের যে উপর পরে তাই পৃথিবী থেকে দৃশ্যমান হয়। যখন সুর্যেল আলো সম্পুর্ন চাঁদকে দৃশ্যমান করে তখনই পুর্ন চাঁদ দৃশ্যমান হয় যাকে আমরা পুর্নিমা বলি। পুর্নিমার পর থেকে চাঁদ আকারে ছোট হতে থাকে এবং অমবস্যার রাতে চাঁদ একদমই দেখা যায়না। এই অমাবস্যার পরে যে ছোট্য কাস্তে আকৃতির চাঁদ দেখা যায় তাকেই নতুন চাঁদ বলা হয় এবং আরবী মাসের প্রথম তারিখ গননা করা হয় সেই চাঁদ দেখা যাওয়ার রাত থেকে। দুটি পুর্নিমার মধ্যে মোটামুটি ২৯ দিন বারো ঘন্টা ৪৪ মিনিট এর ব্যবধান থাকে। এখন পৃথিবী,চাঁদ এবং সূর্য সবকিছূই তার জন্য নির্দিস্ট কক্ষপথে আবর্তন করে চলছে। পৃথিবী তার আবর্তনের জন্য এর অর্ধাংশে দিন ও অপরঅর্ধে রাত থাকে। সুর্যের আলোর প্রখরতা ও অন্যান্য কারনে দিনের বেলা চাঁদ খুব কমই দৃশ্যমান হয়। নতুন চাঁদ গননা করা হয় কেবল মাত্র সুর্যাস্তের পর। এখন পৃথিবীথেকে চাঁদ ও সুর্যের দুরুত্ব ও অবস্থানের ভিন্নতার কারনে এবং দিবারাত্রির প্রভাবে পৃথিবীর সকল স্থান থেকে একই সময়ে নতুন চাঁদ দৃশ্যমান হয়না। যে কারনে সাধারনত আমাদের দেশের রমজান এবং ঈদ মধ্যপ্রাচ্যের একদিন পরে উদযাপিত হয়। কিন্তু এরকম সবসময় হওয়া বাধ্যতামুলক নয়। যেহেতু এটি চাঁদ নির্ভরযোগ্য ব্রক্তির সচক্ষে দেখার উপরই নির্ভরশিল। চাঁদের আবর্তন সময় হচ্ছে প্রায় সাড়ে উনত্রিশ দিন। সুতারং উনত্রিশতম রাত্রেও ানেক যায়গায় চাঁদ দৃশ্যমান হয়্। আবার পৃথিবীর অনেক জায়গায় নতুন চাঁদ দৃশ্যমান হয় আগের মাসের তিরিশতম সন্ধায়।
এখন এবছর দেখা যাচ্ছে সৈীদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্য এবং আমাদের দেশে একই দিনে মুহররম মাস শুরু হয়েছে। এবং সেই ধারাবাহিকতায় ১০ই মুহররম আশূরা একই দিনে পালিত হচ্ছে। উভয় দেশের সরকারী চাঁদ দেখার জন্য নির্ধারিত পরিষদ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনেকে বলছেন এটি সম্ভব নয় এবং বাংলাদেশে মুহররম আগামীকাল ৭ই ডিসেম্বর পালন করতে হবে। আমি মনে করছি এই দাবি অত্যন্ত অযেীক্তিক। গত নয়দিন বাংলাদেশের কোন উল্লেখযোগ্য আলেম এই বিষয় নিয়ে কোন বক্তব্য রাখেননি। অন্যদিকে সেীদি আরবে সম্ভবত দুই দিন পর সিদ্ধানত নেয়া হয় যে মুহররম মাস ইংরেজি ২৭শে নভেম্বর এর দিন এবং এর পুর্বরাত ২৬ শে নভেম্বর থেকৈ গননা করা হবে। ২৫ শে নভেম্বর এর রাতে নির্ভরযোগ্য চাঁদ দেখার সংবাদ না পাওয়ায় তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। উভয় দেশের চাঁদ দেখ কমিটিই কোন ভুল করেছে বলে মনে হয়না। ইউএস নেীবাহিনীর পরিচালিত নিন্মের ওয়েবসাইটে পৃথিবীর সকল ষ্থান থেকে চাঁদ ও সুর্যের অবস্থান সংক্রান্ত সম্ভাব্য তথ্য ও উপাত্ত পাওয়া যায়।
http://aa.usno.navy.mil/data/docs/RS_OneDay.php

এই সাইটের তথ্য অনুসারে পবিত্র মক্কা নগরীর অক্ষাংশ ২১ ডিগ্রি ২৫ মিনিট এবং দ্রাঘিমা ৩৯ ডিগ্রি ৪৮ মিনিট এর ২৫ এ নভেম্বর রাতে চাঁদ ও সুর্যের সম্ভাব্য সময়গুলি হচ্ছে।
(longitude E39.8, latitude N21.4):
Friday 25 November 2011 Universal Time +3h

SUN
Begin civil twilight 06:14
Sunrise 06:38
Sun transit 12:08
Sunset 17:37
End civil twilight 18:01

MOON
Moonset 16:52 on preceding day
Moonrise 06:37
Moon transit 12:14
Moonset 17:51
Moonrise 07:41 on following day
New Moon on 25 November 2011 at 09:10

অর্থাত এই দিন সুর্যাষ্ত হবে সন্ধা পাঁচটা সাইত্রিশ মিনিটে অন্যদিকে চাঁদ দেখা যাবে পাঁচটা একান্ন মিনিট পর্যন্ত। অর্থান সুর্যষ্তের পর মাত্র বার মিনিট চাঁদ দৃশ্যমান থাকবে। এই সময়ের মধ্যে চাঁদের অতি ক্ষুদ্র যে অংশ দেখা যাবে তা খালি চোখে না দেখার সম্ভাবনা প্রবল। সুতারাং সৈীদি কর্তৃপক্ষ এই দিন চাঁদ দেখা না যাওয়া স্বাভাবিক ভাবেই পরেরদিন দিবাগত রাত অর্থাত ২৬ শে নভেম্বর থেকে মুহররম মাস গননা করছে। সৈীদি আরবের অন্যান্য অঞ্চলের মধ্যেও সর্বোচ্চ দশ মিনিটের ব্যবধান থাকায় অন্যান্য অঞ্ছলেও চাঁদ দেখা না যেতে পারে। কারন মক্কা নগরী সেীদি আরবের পশ্চিম দিকে অবস্থিত এবং এর পুর্বের অঞ্চলে আরো আগে সুর্যাস্ত হয়।
অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারের চাঁদ দেখা কমিটি ২৬শে নভেম্বর দিবাগত রাত থেকে ১লা মুহররম গননা শুরু করেন যার কারনে আজকে ৬ই ডিসেম্বর ১০ই মুহররম আশুরার দিন হিসেবে পালিত হচ্ছে। একই ওয়েবসাইট এর তথ্য অনুসারে ঢাকার অক্ষ ও দ্রাঘিমাতে সম্ভাব্য সময়।

(longitude E90.4, latitude N23.7):
Saturday 26 November 2011 Universal Time + 6h

SUN
Begin civil twilight 05:56
Sunrise 06:20
Sun transit 11:46
Sunset 17:11
End civil twilight 17:35

MOON
Moonset 17:15 on preceding day
Moonrise 07:15
Moon transit 12:46
Moonset 18:17
Moonrise 08:15 on following day

Phase of the Moon on 26 November: waxing crescent with 1% of the Moon's visible disk illuminated.
এই উপাত্ত অনুসারে ২৬ শে নভেম্বর রাতে ঢাকায় সুর্যাস্ত হবে পাঁচটা এগারো মিনিটে এবং চাঁদ দেখা যাবে ছয়টা সতের পর্যন্ত। অর্থাত প্রায় একঘন্টা সময় চাঁদ দৃশ্যমান থাকবে এবং পুর্নিমার সময় যে পুর্ন চন্দ্র দেখা যায় তার এক শতাংশ আকৃতির চাঁদ দেখা যাবে। এই টুক আকৃতির চাঁদ দেখার জন্য এক ঘন্টা যথেষ্ট সময়। সুতারাং ২৬শে নভেম্বর দিবাগত রাত থেকে মুহররম মাস গননায় কর্তৃপক্ষ কোন ভূল করেছেন বলে মনে হয়না।

গত নয়দিন ধরে এই দিনটি নির্ধারিত থাকলেও কোন উল্লেখযোগ্য আলেম বা সংগঠন এর বিরোধিতা করেছেন বলে আমার জানা নাই। কেন্ জানি ব্লগে গত দু্ই একদিন ধরে অনেকে মত প্রকাশ করছেন যে যেহেতু সেীদি আরবে আজকে দশই মুহররম পালন করা হচ্ছে সেহেতু আমাদের দেশে আগামীকাল ১০ই মুহররম ধরা উচিত। এই দাবির পক্ষে কোন যুক্তি আমার নজরে আসছেনা। এরা অনেকটা তাদের মতই আচরন করছেন যারা প্রতি বছরই বাংলাদেশের কয়েকটি স্থানে সেীদি আরবের সাথে মিলিয়ে রোজা ঈদ পালন করা হয়। চাঁদ দেখা গেছে কি যায়নি তা বিবেচনা করা হয়না। অন্যদিকে কালকে বাংলাদেশে ১০ই মুহররম নির্ধারনের জন্য যারা দাবি করছেন তারাও অনেকটা সেভাবেই সেীদি আরবের একদিন পর এখানে চাঁদ দেখা যাওয়াটা বাধ্যতমুলক বলে মনে করছেন। যেহেতু নিজের দেশে চাঁদ দেখার উপরই আরবী তারিখ নির্ধারিত হয় সুতারাং আমাদের দেশে যেহেতু তথ্য ও উপাত্ত অনুসারে ২৬শে নভেম্বর সন্ধায় দির্ঘ সময় ধরে নতুন চাঁদ দেখা যাওয়ার সম্ভবনা আছে সুতারাং কর্তৃপক্ষ নিশ্চই নির্ভরযোগ্য ব্যাক্তির চাক্ষুস সাক্ষের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত নয়দিন যেহেতু কোন উল্লেখযোগ্য আলেম এর প্রতিবাদ করেননি সুতারাং একে ভুল বলে মনে করার কোন কারন দেখছিনা।

বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও সাহারার ইতিকথা।

সাহারা গ্রুপ বাংলাদেশে আবাসন খাতে বিনিয়োগ করার জন্য চুক্তি সাক্ষর করেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতি পুর্ন দেশ হওয়ার কারনে এখানে জমির মুল্য অনেক (সিঙ্গাপুর বা হংকং তত্বগতভাবে আরো বেশি ঘনবসতি পুর্ন হলেও সেগুলি ক্ষুদ্রাকৃতি সিটি স্টেট)। সেখানে সাহারা গ্রুপকে রাজধানির আশেপাশে একলক্ষ একর জমি দেওয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে রাজউক। অর্থাত এই জমি হুকুম দখল আইন প্রয়োগ করে সামান্য ক্ষতিপুরন দিয়ে বর্তমান মালিক দের থেকে নেয়া হবে এবং তা সল্পমুল্যে সাহারার কাছে স্থানান্তর করা হবে। এই ক্ষতিপুরন ও আবার দেওয়া হবে জমির মালিকদের আবেদনের ভিত্তিতে। মানে আপনি যদি নিজে জমির মালিক হন তবে আপনাকে দেীড়াদেীড়ি করে এবং প্রচুর ঘুষ দিয়ে নিজের উত্তরাধিকার কিংবা ক্রয় সুত্রে প্রাপ্ত জমির অনুপযুক্ত মুল্যটি আদায় করতে হবে। বাংলাদেশে মাথাপিছূ জমির পরিমান মাত্র .২৫ একর। অর্থাত এই পরিমার জমি সাহারাকে দেওয়ার জন্য বাস্তুহারা করতে হবে কমপক্ষে ৪ লক্ষ লোক। আর এই এলাকা ডেভেলপ করে সাহারা উচ্চমুল্যে এই জমি পুনঃবিক্রিয় করবে তারা সন্দেহাতিতভাবে হবে উচ্চবিত্ত ( অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটি ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলছি, যেখানে আমাদের দেশে ৭-৮ সদস্যের একটি পরিবার ৬০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট এ বসবাস করেন সেখানে একজন ব্যবসায়ির বেডরুমের আয়তন দেখেছি ১৪০০ বর্গফুট)। ইতঃমধ্যে আমাদের দেশের আবাসন ডেভেলপমেন্ট সেক্টর ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সেক্টর থেকে এই ব্যাপারে বিভিন্ন আপত্তি উঠেছে।
এই সাহারাগ্রুপ এবং এর মালিক সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দিচ্ছি। সাহারার ইতিহাস শূরু ১৯৭৮ সালে। বর্তমানের সাহারা ম্যানেজিং ওয়ার্কার( সাহারাগ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদবির বদলে এই পদবি ব্যবহার করে) সাহারাশ্রী সুব্রত রায় কিন্তু এর প্রতিষ্ঠাতা নন। এটি ছিল একটি ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রতিষ্ঠান এবং মার্কেটিং এর কাজ ও করত। অন্যদিক থেকে বলতে গেলে এটি আজকের এমএলএম প্রতিষ্ঠানগুলির পুর্বসুরি। তবে এই প্রতিষ্ঠান ভারতে ক্ষুদ্র সঞ্চয় ও ঋনদান সংস্থা হিসেবে লাইসেন্স প্রাপ্ত ছিল। সুব্রত রায় ১৯৭৮ সালে এই সংস্থার যখন একবারে শৈশব তখন সেখানে এজন্ট হিসেবে যোগদেন। সুব্রত রায় এর জন্ম ও বসবাস বিহারের গোরখপুরে। প্রকৃত বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলায়। পিতা ছিলেন সুগার মিলের উচ্চপদস্থ ইঞ্জিনিয়ার। কলকাতা,বেনারস বিভিন্ন জায়গায় স্কুল জীবন পার করেন। গোরখপুর পলিটেকনিক থেকে মেকানিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডিপ্লোমা করার পর বিভিন্ন প্রকার ব্যবসার চেষ্টা করেন কিন্তু কখনও চাকরি করেননি। ১৯৭৮ সালে পিতার মৃত্যুর পর কিছূটা সমস্যায় পরেন তিনি। এই সময় তার মা তৎকালিন সাহারা প্রতিষ্ঠানে মাসিক ভিত্তিতে কিছূ অর্থ সঞ্চয় করতেন সে সুত্রে এই প্রতিষ্ঠানের সাথে পরিচিত হন তিনি। তিনি স্থানিয় ব্যাক্তি হওয়ায় এজন্ট হিসেবে বেশ সাফল্য অর্জন করেন এবং ধিরে ধিরে এই প্রতিষ্ঠানের একক নিয়ন্ত্রক এর ভুমিকায় উঠে আসেন। তিনি প্রাপ্ত সঞ্চয় শুধুমাত্র সরকারী বন্ড বা সিকিউরিটিতে বিনিয়োগ এবং ঋনদানের বদলে সঞ্চিত টাকা সংস্থার নিজস্ব উদ্যোগে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন। এই উদ্যোগ থেকে প্রথমেই শুরু হয় সাহারার আবাসন ব্যবসা। অসংখ্য ক্ষুদ্র সঞ্চয় একত্র করে এই প্রতিষ্ঠান বৃহত পুঁজি গঠন করতে সমর্থ হয়। এরপর এই প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করে মিডিয়া,টুরিজম, সাস্থ সেবা , হোটেল ,পরিবহন,তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি খাতে। এই প্রতিষ্ঠানের মূল ব্যবসা ক্ষুদ্র সঞ্চয় ও বিনিয়োগ ও বর্তমানে চালু আছে। সেই সঙ্গে এই সঞ্চয় এর বিপরিতে নিত্য প্রয়োজনিয় সামগ্রি সরবরাহের ব্যবসাও এর অন্যতম লাভজনক ব্যবসা। এছাড়াও খাদ্য সরবরাহকারী চেইন শপ ”কিউ শপ” এর মালিক ও এই গোষ্ঠি। সাহারা এয়ার লাইন্স নামে বিমান পরিবহন সংস্থাও চালু করা হয়েছিল কিন্তু লাভ করতে না পারায় তা জেট এয়ারওয়েজ Í কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের মার্কেট ক্যাপিটাল ২৫ বিলিয়ন ডলার এবং বাৎসরিক আয় প্রায় ৭৩ হাজার কোটি রুপি। এছাড়া আইপিএল এর পুনে ওয়ারিয়র্স এর মালিক সাহারা। রেসিং কার সহ ক্রিড়া ক্ষেত্রেও এর প্রচুর বিনিয়োগ এবং স্পনসর আছে।
অন্যান্য ব্যবসায়িক গ্রুপের সাথে এর কিছূ মেীলিক পার্থক্য আছে। যেমন এর কর্মিরা শুধু কর্মচারি নন বরং প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হোল্ডার ও হয়ে থাকেন। লাভের একটি বড় অংশই কর্মিকল্যানে ব্যায় হযে থাকে। প্রধান কর্মচারিদের সাথে নিন্মপদস্থ কর্মচারিদের বেতন বা পদমর্যাদায় পার্থক্য যাই থাকুকনা কেন প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য সুযোগসুবিধা সমান পান। কর্পোরেট সংস্থাগুলিতে যেখানে বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তার জন্য বিভিন্ন মানের ক্যান্টিনও থাকে সেখানে সাহারার প্রধান সহ সকলেই সংষ্থার হেড অফিসে একই ক্যান্টিনে একই খাবার গ্রহন করেন। প্রতিস্ঠানের প্রধান কর্মচারিরা ডিরেক্টের বা ম্যানেজার এর বদলে ম্যানেজিং ওয়ার্কার বলে পরিচিত। আরেকটি জিনিস এই গ্রুপটিতে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য যেখানে ভারতের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলি উচ্চবেতনে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ম্যনেজমেন্ট এর মত বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানথেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত সদ্য গ্রাজুয়েট দেরকে নিযুক্ত করে সেখানে এই প্রতিষ্ঠান এর বেশিরভাগ কর্মকর্তাই সাধারন কলেজ বা অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত। এখানে ডিগ্রির চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া কাজের যোগ্যতার। বর্তমানে সাহারা ভারতে বেসরকারী সর্ববৃহত মানব সম্পদের অধিকারি এবং সমগ্র ভারতে রেলওয়ের পর বৃহত্তম এমপ্লয়ার। যদিও এদের একটি বড় অংশই স্থায়ি কর্মচারি নন। বরং কমিশনের ভিত্তিতে আমানত সংগ্রহ করেন এবং নিত্তপ্রয়োজনিয় দ্রব্যাদি ক্রেতার কাছে সরবরাহ করেন। তবে তারাও ইন্সুরেন্স,চিকিৎসা সহ অন্যান্য সুবিধা পেয়ে থাকেন। সাহারার নামটি নিয়েও বেশ হাস্যকর একটি ব্যাপার আছে। প্রকৃত পক্ষে এই প্রতিষ্ঠান টির নাম ছিল সহারা অর্থাত হিন্দি ভাষায় সাহাজ্য। কিন্তু ইংরেজি বানান ও উচ্চরনে সাহারা হয়ে গেছে। মোটের উপর একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে সাহারা বেশ ভিন্নতর। এর প্রধান সুব্রত রায় ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নিজস্ব নিতি অনুসরন করে চলেন এবং তিনি যথেষ্ট সফল।

ব্যাসায়িক ক্ষেত্রে সফল ও ভাল প্রতিষ্ঠান হলেও বাংলাদেশে সাহারার বিনিয়োগ বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হবে কিনা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের কারন আছে। সাহারা আবাসন খাতে প্রধানত ব্যবসা করে থাকে ভারতের মহারাষ্ট্র ও উত্তর প্রদেশে। জনবহুল হলেও এই দুটি রাজ্যে প্রাকৃতিক কারনে অনেক জমি অব্যবহত ছিল। সাহারা বিশাল বিনিয়োগ এর মাধ্যমে এই জমি কে ভরাট ও পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা করে তাকে ব্যবহার উপোযোগি করেছে। সেখানে বাংলা দেশে একটি নতুন শহর প্রতিষ্ঠার জন্য এক লক্ষ একর জমি ঢাকা নগরীর আশে পাশে রাজউক এর আওতার মধ্যে এক সাথে পাওয়ার চিন্তা করাই অসম্ভব। এই এলাকার মধ্যে ইতঃমধ্যেই দেশিয় প্রতিষ্ঠানগুলি প্রচুর বিনিয়োগ করেছে এবং এখানে তাজা শাকসবজি এবং দুধ ডিম সহ বিভিন্ন কৃষি পন্যের খামার ও গড়ে উঠেছে। সুতারাং এই পরিমান জমি যদি সল্পমুল্যে সাহারাকে দেয়া হয় তাহলেকৃষি ক্ষেত্রেও বিরাট ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সুতারাং এই বিনিয়োগ কতটুক দেশের স্বার্থে হবে তানিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। সাহারা গ্রুপ যদিও অনেক বেশি জনকল্যানমুলক তথাপি তারা ব্যবসা করার উদ্যেশ্যেই আসবে এবং এ ব্যাপারে তাদেরও কোন লুকোচুরি নাই। বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে সাহারা গ্রুপ কে বিনিয়োগ করার সুযোগ দিয়ে যে পরিমান কর্মসংস্থান হবে সেই সুযোগসুবিধা গুলি যদি দেশিয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে দেয়া হয় তা হলে সেগুলি অনেক বেশি কর্মসংষ্তান সৃস্টি করতে পারবে। আর নিশ্চিত ভাবে বলা যায় সাহারা গ্রুপ তাদের প্রকল্পে কখনই অর্ধেক এর বেশি কর্মচারি এদেশ থেকে নিয়োগ করবে না এবং নিশ্চিতভাবেই উচ্চ পদে নিয়োগ করবেনা। অন্য দিকে আবাসন সংশ্লিষ্ট শিল্প গুলি যথা ইট,সিমেন্ট,রড,রং,এলুমিনিয়াম, টাইলস ইত্যাদির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ এখন অনেক এগিয়ে আছে। সেখানে সাহারা নিম্চিতভাবেই তাদের নিজস্ব কারখানায় তৈরি এই জিনিসগুলি ব্যভহার করবে যেখানে দেশিও প্রতিষ্ঠানগুলি দেশের জিনিস ব্যবহার করে। সব মিলিয়ে বর্তমান শর্তে সাহারার বিনিয়োগ প্রকৃত পক্ষে কতটুক লাভ জনক হবে তা চিন্তার বিষয়।

* সাহারা ও সুব্রত রায় সংক্রান্ত তথ্যগুলি ইন্টারনেট এবং ভারতের বিশিষ্ট সাহিত্যিক শংকর রচিত
" বাঙ্গালীর বিত্ত সাধনা সাহারার ইতিকথা" বইটি থেকে নেয়া হয়েছে।

শাহানশাহ ই গজল। মেহদি হাসান।

দুনিয়া কিসিসে পেয়ার হ্যায়,মুঝে তুম নযর সে, রনজিস ই সহি। অসংখ্য হৃদয় আলোকিত উদ্বেলিত করা গজল এর শিল্পি মেহদি হাসান চলে গেছেন আজ ১৩ই জুন,২০১২। তার উপাধি ছিল শাহানশাহ ই গজল বা গজল সম্রাট। আধুনিক গানের যন্ত্রপ্রধান সংগিতের মধ্যেও বানী ও সুর প্রধান গজল কে উপমহাদেশের তরুন সমাজের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে তার অবদান অবিস্মরনিয়। পাশাপাশি তিনি আধুনিক উর্দু,হিন্দি এবং বাংলা গানও গেয়েছেন। পাকিস্তানি উর্দু ছায়ছবির অসংখ্য হিট গানের প্লে ব্যাক করেছেন তিনি। তবে তার প্রধান পরিচয় অবশ্যই গজল শিল্পি হিসেবে। তার গাওয়া গানের সংখ্যা ২০০০০ এর উর্ধে।
মেহদি হাসান এর জন্ম বর্তমান ভারতের রাজস্থানের বিখ্যাত গ্রাম লুনি তে ১৯২৭ সালের ১৮ই জুলাই। ছোট হলেও লুনি গ্রামটি সংগিতের জন্য বিখ্যাত। সত্যজিত রায় তার ”গুপি গাইন বাঘা বাইন” এবং ” সোনার কিল্লা” ছবির শুটিং করেছিলেন সেখানে এবং এই ছায়ছবিতে ব্যবহার করেছিলেন সেই গ্রামের অধিবাসিদের গাওয়া ও বাজান সঙ্গিত। মেহদি হাসান এর পিতা উস্তাদ আজিম খান ও চাচা উস্তাদ ইসমাইল খান এর থেকে সঙ্গিতে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। তার পরিবার অনেক পুরুষ ধরেই চলে আসছে সঙ্গিত চর্চার ধারা। অল্প বয়সেই তিনি বিভিন্ন জলসায় গান গাইতে শুরু করেন। প্রধানত ধ্রুপদি ও খেয়াল গানই গাইতেন তখন। ১৯৪৭ সালে উপ মহাদেশ বিভক্ত হওয়ার পর তিনি তার ভাই সহ চলে আসেন পাকিস্তানে। পাঞ্জাবের একটি ছোট শহরে সাইকেলের দোকানে ছোট্ট কাজ নিয়ে শুরু করেন নতুন জিবন। পরে ট্রাকটর ও গারি মেকানিক হিসেবেও কাজ করেন জিবন যাপনের জন্য। কিন্তু সঙ্গিত এর চর্চা কখনই বন্ধ করেননি শত প্রতিকুলতা সত্বেয়। ১৯৫৭ সালে রেডিওতে গান গাওয়ার সুযোগ পান তিনি। প্রথম দিকে শুধু উচ্চাঙ্গ সঙ্গিত গাইতেন কিন্তু এরপর গাইতে শুরু করেন গজল যা তাকে পেীছে দেয় খ্যতি ও সাফল্যের উচ্চ স্তরে। ষাটের দশকের শুরুতে ছায়ছবিতে প্লেব্যাক গাওয়া শুরু করেন তিনি। ছায়াছবিতে গাওয়া তার প্রথম গানটি ছিল ফয়েজ আহমদ ফয়েজ রচিত বিখ্যাত চির সবুজ গজল ”গুল মে রঙ্গ ভরে বাদল বাহা চলে”। ছায়ছবিতে গজল ছাড়াও আধুনিক হিট গান ও গেয়েছেন তিনি। এরমধ্যে রয়েছে যব কোই পেয়ারসে বুলায়গা, মুঝে দিলসে না ভুলানা, ইয়ে তেরে আনা, রাফতা রাফতা ও মেরে এই ধরনের চিরনতুন গান। তৎকালিন পাকিস্তানের প্রায় সকল শিল্পির সঙ্গেই গান গেয়েছেন তিনি। আমাদের দেশের ফেরদেীসি রহমানের সঙ্গেও বিখ্যাত গান রয়েছে তার। বাংলায় ও গান গেয়েছেন তিনি। তার বাংলা গানের একটি ক্যাসেটও বের হয়েছিল। বাংলা ছায়ছবিতে তার গাওয়া হিট গান রযেছে ”ঢাকো যতনা নয়ন দুহাতে”। মেহদি হাসানের একটি বড় কাজ বাহদুর শাহ জাফর,দাগ, হসরত মোহানির মত বিখ্যাত উর্দু গজল রচয়িতাদের গান নতুন করে পরিবেশন করা। শেষ মুঘল সম্রাট বাহদুর শাহ জাফরের রচিত ”বাত করনি মুঝে মুশকিল কাভি অ্যায়সে নাথে” এবং ”না কিসি আঁখ কি নুর হু” গজল দুটি মেহদি হাসানের কণ্ঠে প্রভুত জনপ্রিয়। রেডিও,টেলিভিশন, ক্যাসেট রেকর্ড, প্লে ব্যাক, এবং জলসায় অপ্রতিদনদ্বি শিল্পি ছিলেন মেহদি হাসান। হামদ,নাত ও তিনি গেয়েছেন অনেক। তার গাওয়া নাত ”লওহ ভি তু কলব ভি তু” অত্যন্ত জনপ্রিয়।
আশির দশকের শেষ দিকে বয়স ও অসুস্থতার জন্য প্লেব্যাক এবং জলসা কমিয়ে দেন তিনি। একবিংশ শতকের শুরুতে প্যারালাইসিস এ আক্রান্ত হন তিনি। এরপর নিয়মিত গান বন্ধ করে দিলেও মাঝে মধ্যে টেলিভিশন বা মিক্সড এলবামের জন্য গান গাইতেন তিনি তার মধ্যে দেশাত্ব বোধক গানই প্রধান। অসুস্থ অবস্থায় গান কয়েকদিন ধরে গেয়ে একেকটি গান রেকর্ড করা হতো। এসময় তার গাওয়া একটি গান "ইয়ে ওয়াতান তুমহারি হ্যায়" সম্পর্কে ইউ টিউবে এক ভারতিয় মন্তব্য করেছিলেন যে তিনি একজন ভারতিয় হয়েও এই গানটি শুনে অশ্রু সম্বরন করতে পারেননি। ভারতের কিংবদন্তি লতা মুঙ্গেশকর বলে ছিলেন তার মেহদি হাসানের সাথে গান গাওয়ার ইচ্ছের কথা। সেই আশা তার পুর্ন হয় ২০০৯ সালে । এইচএমভি দুজনের হাওয়া একমাত্র ডুয়েট "তেরে মিলনা বহুত আচ্ছা লাগতা হ্যায়" প্রকাশ করে। সম্ভবত এটাই তার শেষ প্রকাশিত গান।
দির্ঘ অসুস্থতার পর গতকাল ১৩ই জুন ২০১২ সালে করাচির আগা খান হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন তিনি।
পাকিস্তানের সর্বোচ্চ পুরুস্কার প্রাইড অব পারফর্মেন্স ও হিলালে ইমতিয়াজ সহ দেশে বিদেশে অসংখ্য পুরুস্কারে ভুষিত হন তিনি। তার চেয়েও বড় হচ্ছে পরস্পর প্রতিদন্বি দুই রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানে তার অসম্ভব জনপ্রিয়তা। সেই সঙ্গে উপমহাদেশে ও এর বাইরেও তার জনপ্রিয়তা অপ্রতিদন্বি। বাংলাদেশে তিনি বেশ কয়েকবার এসেছেন। স্বাধিনতার আগে অনেক জলসায় এসেছেন। স্বাধিনতার পর বিটিভির ২৫ বছর পুর্তি উপলক্ষে একক সংগিতানুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেছিলেন তিনি।
তার জিবনের একটি উল্লেখ যোগ্য ঘটনা হচ্ছে নেপালের রাজদরবারে সঙ্গিত পরিবেশনের সময় তার বিখ্যাত জিন্দেগি ম্যায় তো সাভি পেয়ার কিয়া করতে হ্যায় গানটি গাইতে গিয়ে হঠাত খেই হারিয়ে ফেলেন তিনি, এই সময় নেপালের পরোলকগত রাজা বিরেন্দ্র বির বিক্রম শাহদেব নিজেই গেয়ে উঠেন তার পরের লাইন, ম্যায় তো মরকরভি মেরে জান তুঝে চাহউঙ্গা।
আমরা এই কিংবদন্তি শিল্পির রুহ এর মাগফিরাত কামনা করছি।
তিনি একদিন গেয়ে গেছেন "মুঝে দিলসে, না ভুলানা, চাহে রুকে ইয়ে যামানা"। আমরা তাকে ভুলতে পারবনা। কারন তিনি ফিরে আসবেন "কাভি নাগমা বনকে,কাভি বনকে আসুঁ"। কখনও সুর হয়ে কখনও বা অশ্রু।


যখন সাফল্যের শির্ষে


মৃত্যর কয়েকদিন আগে।


ফেরদেীসি রহমানের সাথে

হাসান আল বান্না থেকে মুহাম্মদ মুরসি। জনতার মুখ চেপে ধরতে উদ্যত শোষক গোষ্ঠি আর জনতার লড়াই।

১৯২৮ সালের মার্চ মাসের কোন এক দিন। মিসরের লোহিত সাগরের তীরবর্তি বন্দর নগরি ইসমাঈলিয়ার এক কফি শপে মিলিত হলেন সাত বন্ধু। এদের মধ্যে প্রধান স্কুল শিক্ষক উস্তাদ হাসান আল বান্না। সকলে মিলে আলোচনা করছিলেন পাশ্চাত্য প্রভাবিত এই ইসমাঈলিয়া নগরির নৈতিক অবস্থা এবং দেশের অবস্থা। একসময় তারা সিদ্ধান্ত নিলেন দেশের মানুষের জন্য কিছু করার। নিজেদেরকে তারা অভিহিত করলেন ইখওয়ান উল মুসলিমিন অর্থাত মুসলিম ভাতৃসঙ্ঘ বলে। সে সময় ইসমাঈরলিয়া বন্দর নগরীটি ছিল মূলত সুয়েজ কোম্পানির নিয়ন্ত্রনে। মিসরের বুক চিরে চলে গেছে সুয়েজ খাল। সেই খাল ব্যবহার করে দক্ষিন ও পুর্ব এশিয়ার উপনিবেশগুলি থেকে লুন্ঠিত সম্পদ নিজ দেশে পাচার করে বৃটেন ও ফ্রান্সের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলি। মিসর তখন আধা স্বাধিন। দেশে একজন বাদশাহ ও নির্বাচিত মন্ত্রি পরিষদ থাকলেও মুল নিয়ন্ত্রক বৃটিশ রাজপ্রতিনিধি বা রেসিডেন্ট। বিদেশি নাগরিক রা মিসরের আইন এর উর্ধে থেকে কাজ করেন। অন্যদিকে সাধারন মিসরিয় রা যতই যোগ্যতা সম্পন্নই হোননা কেন সুয়েজ কোম্পনিতে শ্রমিকের উপের চাকরির সুযোগ নাই তাদের। ইসমাঈলিয়ার সেই সময় একই সাথে সমাজ সংস্কার আর আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার প্রতিষ্ঠায় সেই তরুন দল যাদের করো বয়স তখন পচিশ পার হয়নি যে আন্দোলনের সূচনা করেছিল তার প্রভাব এখন মিসর ছাড়িয়ে সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের আন্দোলনে ভিত হয়ে উঠে পশ্চিমা শোষক আর তাদের তাঁবেদার গোষ্ঠি। চরম দমন আর নিপিড়নের শিকার হলো ইখওয়ান আল মুসলিমিন। ১৯৪৯ সালে শহিদ করে দেয়া হলো এর প্রতিষ্ঠাতা হাসান আল বান্নাকে। ১৯৫২ সালে কর্নেল নগিব এর নেতৃত্বে এক বিপ্লব হলো সেখানে। ঔপনিবেশিকরা সরাসরি নিয়ন্ত্রন হারাল। গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করার কথা দিল নতুন বিপ্লবি কাউন্সিল। কিন্তু তার মধ্যে ঢুকে গেছে তখন কয়েকজন বিশ্বাসঘাতক। জামাল আবদুল নাসের বিপ্লবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে জেনারেল নগিবকে সরিয়ে একনায়কের স্বৈরশাসন কায়েম করল। ষাট বছর ধরে মাত্র তিনজন শাসক শাসন ও শোষন করে গেছে মিশরকে।
কিন্তু শত অত্যাচার নিপিড়ন,ফাঁসি,গুপ্তহত্যা ও দমিয়ে রাখতে পারেনি মিশরের জনগনকে। একদিকে ইসরাইলি আগ্রাসন। অন্যদিকে পশ্চিমা শক্তির মদদ পুষ্ট সামরিক শক্তিতে বলিয়ান শাসকদের অত্যাচার লুটপাটের প্রতিবাদে দেড় বছর আগে রাস্তায় নেমে আসে জনগন। পদত্যাগ করতে বাধ্য হন প্রেসিডেন্ট হুসনি মুবারক। সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রন গ্রহন করে। কিন্তু কায়েমি স্বার্থবাদি শক্তি এত সহজে তাদের ক্ষমতা ছাড়তে রাজি নয়। জনগনের বিপ্লবকে ছিনতাই করার প্রচেষ্টা শুরু হয় পশ্চিমা শক্তির প্রত্যক্ষ মদদে। অনেক ধানাই-পানাই করে প্রথমে সংসদ নির্বাচন দেয় শাসনকারী সেনা পরিষদ। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে ইখওয়ান বা মুসলিম ব্রাদারহুড এর সমর্থিত রাজনৈতিক দল। নতুন সংবিধান প্রনয়নের কাজ শুরু করে তারা। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কাজ ও শুরু হয়। কিন্তু সংসদ নির্বাচনে জনগনের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে কায়েমি শক্তি নতুন ষড়যন্ত্রের সুচনা করে। হুসনি মুবারক এর অন্যতম সহযোগি আহমদ শফিকে প্রার্থি করা হয় প্রেসিডেন্ট পদে। প্রথমে তার প্রার্থিতা নতুন সংসদ প্রনিত আইনে বেআইনি হলেও হুসনি মুবারকের আমলে নিযুক্ত বিচারপতিদের সহায়তায় প্রথমে তার প্রার্থিতা নিশ্চিত করা হয় অন্যদিকে এক পর্যায়ে সংসদ বাতিল করে দেয়া হয়। সামরিক পরিষদকে নির্দেশ দেয়া হয় তাদের পছন্দমত একটি কনভেনশন তৈরি করে নতুন সংবিধান প্রনয়নের। এই গনতান্ত্রিক! আদেশ নজির বিহিন। নির্বাচিত সংসদ সংবিধান প্রনয়ন করবে না বরং অনির্বাচিত ব্যাক্তিরা সংবিধান প্রনয়ন করবে।
এদিকে পেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথম স্থান অধিকার করেন ব্রাদারহুড সমর্থিত জাস্টিস পার্টির মুহাম্মদ মুরসি। আর সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আহমদ শফি দ্বিতিয় স্থান অধিকার করে। যদিও কমপক্ষে শতকরা ৫০ ভাগ ভোট কেউই লাভ করেনি। এ অবস্থায় দ্বিতিয় দফা নির্বাচনের ঘোষনা দেয়া হয়। নির্বাচনের বেসরকারি ফলাফলে মুহ্ম্মাদ মুরসির বিজয় নিশ্চিত হলেও বিভিন্ন কারীগরি করে আহমদ শফি কে বিজয়ি করার ষড়যন্ত্র শুরু হয় সাথে সাথেই। গত বৃহস্পতিবার ফলাফল ঘোষনার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত টানাটানি করে আজকে মুহাম্মদ মুরসিকে বিজয়ি ঘোষনা করল নির্বাচন কমিশন।
অভিনন্দন জনাব মুরসি।
তার সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। জনগনের প্রত্যাশা একটি গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র্। কিন্তু গত ষাট বছর ধরে নিজেদেরকে ক্ষমতার কেন্দ্রে দেখা সেনাবাহিনী আর পশ্চিমা শক্তির প্রতি পুর্ন অনুগত বিচার বিভাগ তাকে জনগনের ইচ্ছা পুরুন করতে কতটুক দেবে তা চিন্তার বিষয়। আমরা আশা করব একটি জনগনের সরকার মিশরে প্রতিষ্ঠিত হবে এবার।

নসীম হিজাযী। উপমহাদেশের ওয়াল্টার স্কট।

নসীম হিজাযী। নিঃসন্দেহে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের মধ্যে একজন এবং উর্দু ভাষার সাহিত্যিক দের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কথা শিল্পি। ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনায় ও তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রশ্নাতিত। কবিতা নির্ভর উর্দু সাহিত্যে গদ্যশিল্পি হিসেবেই তাকেই প্রধান বিবেচনা করা যায়। তার সমসাময়িক সাদত হাসান মান্টো,ইসমত চুঘতাই, কুররাতুল আইন হায়দার বা ইবনে শাফি উর্দুভাষায় গদ্য লেখক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেও তাদের প্রধান সাফল্য ছিল ছোট গল্পে। উপন্যাস রচয়িতা বিশেষ করে ঐতিহাসিক উপন্যাস রচয়িতা হিসেবে তার স্থান সবার থেকে উপরে। আদর্শগত ভাবেও নসীম হিজাযী তার সমসাময়িক সাহিত্যিকদের অনেক বিপরিত। ভারত বিভাগের সময় নিজের জন্মভূমি ছেড়ে আসতে বাধ্য হওয়া নসীম হিজায়ী ছিলেন ইসলামের একজন একনিষ্ঠ অনুসারি ও ইসলামের ইতিহাসের একজন গবেষক। অন্যদিকে তার রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাস গুলির ঐতিহাসিক সত্যতা ও প্রশ্নাতিত। ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে রোমান্টিক কাহিনী সংযোজন করে একই সঙ্গে সুখপাঠ্য উপন্যাস রচনায় তাকে স্যার ওয়াল্টার স্কট এর সমকক্ষ বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে স্যার ওয়াল্টার স্কটের তুলনায় তার রচনায় ঐতিহাসিক তথ্যের কোন ভুল বা মিথ্যার উপস্থিতি নাই। বাংলা ভাষায় ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রথম লেখক বঙ্কিমচন্দ্র যে দোষে খুবই দুষ্ট। বঙ্কিম নিজের আদর্শ প্রচারে ঐতিহাসিক তথ্যের বিকৃতি ঘটাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। সে খানে নসীম হিজাযী তার ঐতিহাসিক সচেতনতা ও নির্ভুলতার জন্য বিশেষ ভাবে আলোচিত।
নসীম হিজাযীর জন্ম অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাব এর গুরুদাসপুর জিলার সুজ্জানপুর গ্রামে ১৯১৪ সালে। তিনি সচ্ছল ও শিক্ষিত পরিবারের সন্তান ছিলেন। তার প্রকৃত নাম মুহাম্মদ শরিফ। যতটুক জানা যায় তিনি লাহোরে বি,এ পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। নিজেদের জমিজমা দেখাশুনা করাই ছিল তার জিবিকা। বিভাগপুর্ব সময়ে অল্প লেখালেখিও করতেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট পাকিস্তান যখন স্বাধিন হয় তখন গুরুদাসপুর জিলা মুসলিম প্রধান হিসেবে পাকিস্তানে অন্তর্ভূক্ত হয়। কিন্তু ১৭ই আগষ্ট রেডক্লিফ কমিশনের রোয়েদাদ ঘোষিত হয় এবং সকল যুক্তিকে পাশ কাটিয়ে গুরুদাসপুর জিলাকে ভারতে অর্ন্তভুক্ত করা হয়। এ অবস্থায় নসীম হিজাযী হিজরত করে পাকিস্তানে চলে আসতে বাধ্য হন। তার জিবনের এই ঘটনা গুলি তিনি পরবর্তিতে উপন্যাসের মাধ্যমে উপস্থাপন করেন। পাকিস্তান আসার পর তিনি সাহিত্যিক এর জিবন যে বেছে নেন। নিভৃতচারি এই উপন্যাসিক ১৯৯৬ সালে ইন্তেকাল করেন। ঐতিহাসিক উপন্যাস ছাড়াও তিনি কয়েকটি ব্যাঙ্গ রচনাও লিখেছেন। তার বেশিরভাগ উপন্যাস এরই মধ্যে বাংলা অনুবাদ হয়েছে। নসীম হিজাযী উপমহাদেশ,স্পেন ও আরবের ইতিহাস নিয়ে উপন্যাস রচনা করেছেন।

তার রচিত উপন্যাস গুলির বিবরন।

স্পেন সংক্রান্ত
১.ইউসুফ বিন তাশফিন: বাংলায় একই নামে অনুদিত। স্পেনে মরক্কোর সুলতান ইউসুফ বিন তাশফিন এর অভিযান এর কথা এই উপন্যাসের বিষয়।
২. শাহিন: "সিমান্ত ঈগল" নামে অনুদিত। স্পেন এর পতনের সময় সিয়েরা নিবেদা অঞ্চলে বদর বিন মুগিরার সংগ্রামের কথা এই উপন্যাসের বিষয়। বদর বিন মুগিরা স্পেনের ঈগল নামে খ্যাত ছিলেন।
৩.আধেঁরি রাত কি মুসাফির: "আঁধার রাতের মুসাফির" নামে অনুদিত। এই উপন্যাসের বিষয় গ্রানাডাকে রক্ষার শেষ চেষ্টা এবং শেষ পর্যন্ত কুখ্যাত এপ্রিল ফুল এর মাধ্যমে গ্রানাডার পতন।
৪.কলিসা আওর আগ( গির্জা ও আগুন): "শেষ রাতের মুসাফির" নামে অনুদিত। এটি আধেঁরি রাত কি মুসাফির এর সিক্যুয়েল। গ্রানাডার পতনের পরবর্তি স্পেন এর মুসলিমদের অবস্থা ও কুখ্যাত ষ্পেনিশ ইনকুইজিশন এর অত্যাচার এর ইতিহাস এই উপন্যাসে আলোচিত হয়েছে।
ইসলাম পুর্ব ও প্রাথমিক যুগ
৫.কায়সার ও কিসরা: ইসলাম পুর্ব আরবের ইতিহাস ও গোত্রিয় দ্বন্দ এবং তৎকালিন দুই পরাশক্তি রোম ও ইরানের যুদ্ধ এই উপন্যাসের কাহিনী। ইসলামের আবির্ভাব ও বিজয় এর কাহিনী এই উপন্যাসের প্রধান বিষয়।
৬. কাফেলায়ে হিজাজ: ইসলাম পুর্ব ইরানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে কাদিসিয়ার যুদ্ধের পরবর্তি অবস্থা এই উপন্যাসের বিষয়।
৭. দাস্তান ই মুজাহিদ: "মরনজয়ি" নামে অনুদিত। এই উপন্যাসে খলিফ ওয়ালিদ এর সময় মুহাম্মদ বিন কাসিম, কুতায়বা বিন মুসলিম, মুসা বিন নুসাইর ও তারিক বিন যিয়াদ এর কাহিনী বর্নিত হয়েছে।
৮.মুহাম্মদ বিন কাসিম: শ্রিলংকার সাথে আরবদের বানিজ্যিক সম্পর্ক, ও মুহাম্মদ বিন কাসিমের জিবন ও সিন্ধু বিজয়ের কাহিনী এই উপন্যাসের বিষয়।
আব্বাসিয় খিলাফতের পতন
৯.আখেরি চাটান: "শেষ প্রান্তর" নামে অনুদিত। চেঙ্গিস খান ও হালাকু খান কতৃক মুসলিম জাহানের উপর হামলা ও ধ্বংসের ইতিহাস এই উপন্যাসের বিষয়।
১০.আখেরি মায়ারকা।
উপমহাদেশ
১১.ইনসান আওর দেওতা: "মানুষ ও দেবতা" নামে অনুদিত। ইসলাম পুর্ব ভারতিয় সমাজের অবস্থা বিশেষ করে বর্নাশ্রম ও অস্পৃশ্যতা এই উপন্যাসের বিষয়।
১২. মুয়াযযম আলি: "খুন রাঙ্গা পথ" নামে অনুদিত। এই উপন্যাসে নবাব আলিবর্দি খান ও নবাব সিরাজদেীলার পতন। পানিপথের তৃত্বিয় যুদ্ধ এবং ইংরেজদের উপমহাদেশের দখলের ইতিহাস বর্নিত হয়েছে।
১৩.আওর তলোয়ার টুট গেয়ি: "ভেঙ্গে গেলো তলোয়ার" নামে অনূদিত। এটি "মুযাযযম আলি" এর সিক্যুয়েল। এই উপন্যাসে মহিশুরের ব্যাঘ্র টিপু সুলতানের সংগ্রামের কাহিনী বর্নিত হয়েছে। যাকে পরাজিত করে ইংরেজরা উপমহাদেশের পূর্ন নিয়ন্ত্রন লাভ করে।
১৪.খাক আওর খুন: এই উপন্যাসে ভারত বিভাগের ইতিহাস এবং বিভাগের সময় হিন্দু ও শিখ কতৃক মুসলিমদের উপর হামলার কাহিনী বর্নিত হয়েছে। পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জিলা যা প্রথমে ভোটের ভিত্তিতে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হলেও রেডক্লিফ এর ষড়যন্ত্রে ১৭ই আগষ্ট ভারত ভুক্ত হয় তার ইতিহাস এবং কাশ্মির যুদ্ধ এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই নামে একটি ছায়াছবি নির্মিত হয়েছে যা উর্দু চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে হিট বলে বিবেচিত।
১৫. পরদেশি দিরখাত(পরদেশি গাছ): "অপরাজিত" নামে অনূদিত। বিভাগ পুর্ব উপমহাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এই উপন্যাসের বিষয় বস্তু। এই উপন্যাস এবং এর সিক্যুয়েল "গুম শুদা কাফিলা" নসীম হিজাযীর নিজের জিবনের কাহিনী নিয়ে লিখা।
১৬. গুমশুদা কাফিলা(হারানো কাফিলা): "রক্ত নদি পেরিয়ে" নামে অনুদিত। ভারত বিভাগ এর সময় ঘটে যাওয়া দাঙ্গা এবং বিভাগ পরবর্তি ইতিহাস এই উপন্যাসের বিষয়।
এছাড়াও নসিম হিজাযী কয়েকটি রম্য ব্যাঙ্গ রচনা ও লিখেছেন যেগুলি হচ্ছে
১৭. সাকফাত কি তালাশ (সংস্কৃতিক সন্ধান)।
১৮.পুরস কি হাতি( পুরুও হাতি)।
১৯,সও সাল বাদ(শতবর্ষ পরে)।
২০.সফেদ জাযিরা(সাদা দ্বিপ) এই রম্য উপন্যাস টিতে পাকিস্তানের আইয়ুব খানের শাসন এর সময়কালকে ব্যাঙ্গ করা হয়েছে।

মিসরের বর্তমান সরকারের নিতি এবং ইসলামি রাষ্ট্র

এক শহরে বসবাস করত দুই বন্ধু। একজন মুসলিম একজন খ্রিষ্টান। মুসলিম বন্ধুটির উৎসাহে আর আচরনে মুগ্ধ হয়ে খ্রিষ্টান বন্ধুটি একসময় ইসলাম ধর্ম গ্রহন করল। তারপর রাত্রে ঘরে এসে সে ঘুমিয়ে পড়ল। গভির রাত্রে তার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। ঘুম থেকে উঠে সে দেখল তার মুসলিম বন্ধুটি এসেছে। মুসলিম বন্ধুটি তার নওমুসলিম বন্ধুটিকে বলল তার সাথে মসজিদে যেতে। অবাক হয়ে নওমুসলিম বন্ধুটি তাকে বলল এখনও তো ফজর এর আজান দেয়া হয়নি। মুসলিম বন্ধুটি তাকে বলল তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় এর জন্য এখনই মসজিদে যাওয়া প্রয়োজন। নওমুসলিম খুশি মনে উৎসাহের সাথে বন্ধুর সঙ্গে মসজিদে গেলো ও তার সাথে নামাজ আদায় করল। ফজরের নামাজের পর সে যখন মসজিদ হতে বের হয়ে যেতে লাগল তখন তার পুরোন মুসলিম বন্ধু তাকে বলল যে এখন বাইরে অন্ধকার আছে সুতারাং এখনই বাইরে না গিয়ে মসজিদে বসে জিকির করতে। নওমুসলিম বন্ধুটি খুশি মনে ই জিকির করা শুরু করল। সুর্যোদয়ের পর পুরোন মুসলিম টি একটি কুরআন শরিফ এনে বলল সুর্যোদয়ের পর কিছুক্ষন কুরআন শরিফ পাঠ করা ভাল। বেচারা নওমুসলিম কুরআন শরিফ পাঠ করতে শুরু করল। কিছুক্ষন পর পুরোন মুসলিম বলল আজকে রোজা রেখে দাও সেটাই ভাল হয়। নওমুসলিম বন্ধু একটু ভিত হলেও মেনে নিল।দেখতে দেখতে জোহর এর সময় হয়ে গেলো। জোহরের নামাজের পর নওমুসলিম বন্ধুটি আবার মসজিদ থেকে বের হতে চাইলে পুরোন মুসলিম বন্ধুটি তাকে বাধা দিয়ে বলল যেহেতু তুমি রোজা রেখেছ খাওয়ার প্রয়োজন নাই। সুতারাং এস আমরা আসর নামাজ পর্যন্ত মসজিদে বসি। আসর নামাজের পর তারা মাগরিব পর্যন্ত বসে থাকল মসজিদে। পানি খেয়ে ইফতার করে নামাজ আদায় করল তারা। নামাজের পর ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত নওমুসলিম বন্ধুটি বিদায় নিতে চাইলে পুরোন মুসলিম তাকে জোড় করেই ধরে রেখে বলল অল্প সময় পর এশার নামাজ আছে সেটা আদায় করেই বের হতে। অগত্যা এশার নামাজ পরে নওমুসলিম বন্ধুটি বাড়ি ফিরে গেলো। পরের রাতেও পুরোন মুসলিম বন্ধুটি আবারও নওমুসলিম বন্ধূটিকে ডাকতে এলে নওমুসলিম বন্ধূটি বলল যে আমি তো গতরাতেই সে ধর্ম ত্যাগ করেছি যা আমাকে সংসার থেকে বিচুত্যকরে ও বিশ্রামহিন ধর্ম অনুসরন করতে বলে।
এই গল্পটি বলে ইমাম জাফর সাদিক তার ছাত্রদের বলেছিলেন বেশি বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে একজন নওমুসলিমকে ইসলাম থেকেই দুরে সরিয়ে দেয়া হলো। কারো শক্তি সামর্থ ও মানসিক অবস্থা বিবেচনা নাকরে যদি ধর্ম পালনে বাধ্য করা হয় তাহলে ইসলামের প্রতি তার আকর্ষন থাকবেনা। বরং তার সামর্থ অনুযায়ি চললেই সে ইসলামের প্রতি আরো আকৃষ্ট হবে এবং আরো ভাল মুসলিম এ পরিনিত হবে।

একটি দেশের জনগন যখন ইসলাম এর সকল বিধান পুরোপুরি গ্রহনের প্রস্তুত কিনা তা বিবেচনা না করে তার উপর যদি জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয় তার ফলাফল ভাল হয়না। আমাদের সামনেই আফগানিস্তান এর উদাহরন আছে। আফগানিস্তানে সরকারি নিতির বিরোধি লোকের সংখ্যা যথেষ্ট থাকায় দখলদার বাহিনী সেখানে আক্রমন করতে সাহস পেয়েছিল। কিন্তু তর্জন-গর্জন করলেও ইরানে এখনই হামলা করছেনা কারন ইরানে আভ্যন্তরিন সহায়তা পাওয়ার সুযোগ খুবই কম। মিসরের সামাজিক অবস্থা যা তাতে প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসি যে নিতি গ্রহন করেছেন তা অবশ্যই েযীক্তিক ও ইসলাম বিরোধি নয়। যারা তার বিরুদ্ধে ইসলাম বিরোধিতার অভিযোগ আনছেন তারা কি এটাই চান যতদিন সকল মানুষ ইসলাম পরিপুর্ন অনুসরন করতে প্রস্তুত হবেনা ততদিন মুসলিমদের রাষ্ট্রক্ষমতা নেওয়ার প্রয়োজন নাই?
সেক্ষেত্রে ইসলাম কোনদিনই প্রতিষ্ঠিত হবেনা। কারন বাতিল সরকার ইসলাম প্রচার করতেই দেবেনা।

জেনারেল ওসমানিকে কি ভুলে গেছি আমরা।

গতকাল ১লা সেপ্টেম্বর ছিল মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানির জন্মবার্ষিকি। সৎ এই মানুষটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রিয় ক্ষমতার অতি নিকটে অবস্থান করেও কখনও ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেননি। দেশকে ভয়ংকর বিপদজনক পরিস্থিতি হতে রক্ষা করেছিলেন নিজের জিবনের উপর ভয়ংকর ঝুঁকি নিয়ে। শত্রুর আক্রমনের মুখে অকুতোভয় হয়ে দৃঢ়চিত্তে নেতৃত্ব দিয়েছেন স্বাধিনতা সংগ্রামে।
এই বীর সৈনিক এর জন্ম সিলেটের সুনামগঞ্জে ১৯১৮ ইংরেজি সালে। পৈতৃক বাড়ি বর্তমান সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার দয়ামির এ। তার পিতা খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ওসমানি ছিলেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। মা জুবেদা খাতুন। তারা হযরত উসমান (রাঃ) এর বংশদ্ভুত বলে ওসমানি বা উসমানি উপাধি ব্যবহার করেন। তার এদেশে বসবাস কারি প্রথম পুর্বপুরুষ ছিলেন শাহ নিজামউদ্দিন ওসমানি যিনি হযরত শাহজালাল এর সাথে সিলেট আগমন করেছিলেন্। সিলেট তখন আসাম প্রদেশ এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাদের পরিবার ছিল উচ্চ শিক্ষিত। যখন বাংলাভাষি বিশেষ করে মুসলিম গ্রাজুয়েট এর সংখ্যা ছিল প্রতি জেলায় গড়ে একজনেরও কম তখনই তাদের পরিবারে চারজন গ্রাজুয়েট ও মাস্টার্স ডিগ্রিধারি ছিলেন। সিলেট সরকারি হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পরিক্ষা উত্তির্ন হয়ে তিনি আলিগড় যান। সেখান থেকে এফ,এ ও বি,এ পরিক্ষায় উত্তির্ন হন। ভুগোলে মাষ্টার্স এর ছাত্র থাকা কালে ১৯৩৮ সালে তিনি তৎকালিন বৃটিশ ভারতিয় সেনাবাহিনীতে যোগদেন। দেরাদুনে ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি থেকে ১৯৪০ সালের অক্টোবর মাসে কমিশন লাভ করেন। তিনি ইন্ডিয়ান আর্মি সার্ভিস কোর এ পোস্টিং পান। উল্লেখযোগ্য তখন সাধারনত কোন ভারতিয় অফিসারকে পদাতিক বা সাজোঁয়া বাহিনিতে পোষ্টিং দেয়া হতোনা এবং বিশেষ করে বাঙ্গালি কোন অফিসারকে তো নয়ই। আর্টিলারি বা গোলন্দাজ বাহিনীর জন্য নির্বাচিত ও প্রশিক্ষিত হলেও এই নিতির জন্য তাকে সরবরাহ বাহিনীতে নিয়োগ করা হয়। পরবর্তিতে দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধ পুর্বভারত পর্যন্ত বিস্তৃত হলে এই নিতি পরিতক্ত হয়। জেনারেল ওসমানি সেকেন্ড লেফটেনান্ট হিসেবে একটি সাপ্লাই ডিপোতে অফিসার হিসেবে যোগ দেন। এরপর তাকে মোটর ট্রান্সপোর্ট ব্যাটালিয়নের সাথে তৎকালিন বার্মা ফ্রন্টে প্রেরন করাহয়। ১৯৪১ সালে তিনি ক্যাপ্টেন পদে উন্নিত হন। ১৯৪২ সালে তিনি অস্থায়ি মেজর পদে উন্নিত হন। তৎকালিন বিশাল বৃটিশ সেনাবাহিনীতে তিনিই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ মেজর। মেজর র‌্যাংক এই তিনি বার্মা ফ্রন্টে একটি মোটর ট্রান্সপোর্ট ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্বপালন করেন যা সাধারনত লেঃকর্নেল র‌্যাংক এর জন্য নির্ধারিত। দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তি ও উপমহাদেশের স্বাধিনতার পর তিনি পাকিস্তানের পক্ষে অপশন দেন। ১৯৪৭ সালে তিনি লেফটেনান্ট কর্নেল পদে উন্নিত হন এবং কোয়েটা স্টাফ কলেজথেকে পিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। জেনারেল ওসমানি স্বেচ্ছায় আবার মেজর র‌্যাংক এ রিভার্সন গ্রহন করেন এবং পাকিস্তানে পদাতিক বাহিনীতে যোগদেন। মেজর ও লেঃকর্নেল হিসেবে তিনি পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ও পাকিস্তান আর্মির হেডকোয়ার্টারএ গুরুত্বপুর্ন দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫১ সালে পুনরায় লেঃ কর্নেল পদে উন্নিত হন এবং ৫/১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এর কমান্ডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এরপর ৯/১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এরও অধিনায়ক হিসেবে ছিলেন। ১৯৫৩ সালে প্রথম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্বগ্রহন করেন। এই ব্যাটালিয়ন ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য সবচেয়ে বেশি পদক লাভ করে। আর বাংলাদেশের স্বাধিনতা যুদ্বে এই ব্যাটালিয়ন সহ ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট এর অবদান আলোচনার অপেক্ষা রাখেনা। ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর অগ্রযাত্রায় তার অবদান অপিরিসিম। তিনি তৎকালিন ইপিআর এর উপ-পরিচালক হিসেবেও কাজ করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি চট্টগ্রামে ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার এর কমান্ডেন্ট পদে যোগ দেন। এরপর ১৯৫৬ সালে কর্নেল পদে উন্নিত হন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে স্টাফ অফিসার হিসেবে যোগ দেন। মাত্র ১৬ বছরে সেকেন্ড লেফটেনান্ট হতে কর্নেল পদে উন্নিত হলেও তৎকালিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙ্গালি বিরোধি দৃষ্টিভঙ্গি ও অন্যান্য ঔপনিবেশিক মানসিকতার জন্য তিনি এরপর আর প্রমোশন পাননি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তখন এবং এখনও পুর্নাঙ্গ কর্নেল পদে অবসর গ্রহন করার ঘটনা খুবই কম। স্ট্রাকচার অনুযায়ি কেউ এক থেকে চার বছরের বেশি কর্নেল পদে থাকেননা। এবং কর্নেল পদে পদন্নোতি পেলেই ধনে নেয়া হতো তিনি যথাসময়ে ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নিত হবেন। কিন্তু কর্নেল ওসমানির বাঙ্গালি মানসিকতা এবং সোজাসাপ্টা স্পষ্টবাদি আচরন তার প্রতি তৎকালিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের বিদ্বেষ পরায়ন করে তোলে। তারা তিনি আর্মি সার্ভিস কোরের অফিসার ছিলেন বলে উচ্চ পদের জন্য অযোগ্য বলে প্রচার করে। তখন পাকিস্থান সেনাবাহিনীতে পদাতিক ও সাঁজোয়া ছাড়া অন্য কোরের সদস্যদের কে হীন চোখে দেখা হতো। অথচ জেনারেল ওসমানি দক্ষতার সাথে তিনটি পদাতিক ব্যাটালিয়নের নেতৃত্বদেন। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অতি গুরুত্বপুর্ন অপারেশন অধিদপ্তরে উপপরিচালক হিসেবে যোগদেন। ১৯৬৫ সালের পাক- ভারত যুদ্ধের সময় তিনি এই পদে ছিলেন। এই দপ্তরের দায়িত্ব সামরিক বাহিনীর সকল অপারেশনাল ও যুদ্ধ সংক্রান্ত কার্যক্রম নিয়ন্ত্রন ও পরিকল্পনা। তাকে এই সময় সার্ভিসে তার জুনিয়র অফিসারদের অধিনে কাজ করতে হয়েছিল কিন্তু তথাপি তিনি দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথেই তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে তার চাকরির পচিশ বছর অতিক্রান্ত হলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে সন্মানজনকভাবে অবসর প্রদান করে। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থাকতে সবসময় বাঙ্গালি সৈনিকদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন এবং ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার এর কমান্ডন্ট ও সামরিক হেডকোয়র্টারে কর্মরত থাকার সময় তার অবদানের জন্য তখন থেকেই পাপা টাইগার নামে খ্যাত ছিলেন। অবসর গ্রহনের পর তিনি সিলেটে বসবাস করতে থাকেন। যদিও পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে প্রাপ্য সন্মান প্রদান করেনি তথাপি ব্যাক্তিগত ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারদের অনেকই তাকে সন্মান করতেন এবং পুর্ব পাকিস্তানে উচ্চপদে পোষ্টিং পাওয়া অনেক অফিসারই তার সাথে দেখা করে যেতেন। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে এলাকার জনগনের দাবিতে রাজনিতিতে যোগদেন এবং আওয়ামি লিগের টিকেটে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তিনি বুঝে নেন যে পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেনা। তিনি তৎকালিন কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত বাঙ্গালী সৈনিকদের একত্রিত করা শুরু করেন। কিন্তু তৎকালিন আওয়ামি লীগ নেতৃত্ব প্রকৃত অবস্থা অনুধাবনে ব্যার্থ হয় এবং ২৫শে মার্চ পাক সেনাবাহিনীর অভিযানেরমুখে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তিনি সেদিনই রাতে ঢাকা ত্যাগ করেন এবং অনেক কষ্টে হবিগঞ্জেরে তেলিয়াপারা দিয়ে সিমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যান। ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরে অস্থায়ি সরকার গঠিত হলে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এর পদ গ্রহন করেন। দক্ষ ও দেশপ্রেমিক অফিসার হওয়ার কারনে তিনি সেসময় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অনেকের কাছেই অপছন্দনিয় ছিলেন। প্রবল জাতিয়তাবাদী ওসমানিকে ভারতিয় সরকার ও সেনাবাহিনীও ভয় করে চলত। ভারতিয় সেনাবাহিনীর যেসকল অফিসার ১৯৭১ সালের মুক্তি যুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন তাদের সবাই ই তার অবদান এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। বর্তমান সরকার কতৃক বিশেষ ভাবে সন্মানিত ভারতিয় সেনাবাহিনীর ইহুদি লেঃজেঃ জেএফআর জ্যাকব লিখেছেন তার সাথে কাজ করা নাকি তার পক্ষে কঠিন ছিল। তিনি মুক্তি যুদ্ধের একপর্যায়ে ভারতিয় চাপে থাকা তৎকালিন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিরোধ হওয়ায় পদত্যাগ করেছিলেন কিন্তু অন্যন্য অফিসার ও মুক্তিযোদ্ধাদের তিব্র প্রতিবাদ ও দাবির মুখে তা প্রত্যাহার করেন। কিন্তু ভারতিয়রা তাকে ভয় করতো বলে চুড়ান্ত বিজয়ের সময় পাকবাহিনীর আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে তাকে উপস্থিত থাকতে দেয়া হয়নি। স্বাধিন বাংলাদেশে তিনি ১৯৭২ সালের ৭ই এপ্রিল পর্যন্ত তিনি সর্বাধিনায়ক এর পদে থাকেন এবং এরপর পুর্নাঙ্গ জেনারেল র‌্যাংক এ অবসর নিয়ে তৎকালিন মন্ত্রিসভায় নৈী ও বিমান চলাচল বিষয়ক মন্ত্রি হিসেবে যোগদেন।
ওসমানি স্বাধিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারদেও আত্মিকরনের পক্ষে বলিষ্ঠ ভুমিকা পালন করেন। এমনকি সেময় মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদেও যে দুই বছর সিনিয়রিটি দেয়া হয় তা প্রবল প্রতিবাদ করেন ওসমানি। ১৯৭৩ সালে তিনি আবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং মন্ত্রিসভায় যোগদেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কে খবই শ্রদ্ধা করলেও তার নিতির সাথে তিনি একমত ছিলেননা। ১৯৭৫ সালের শুরুতে যখন একদলিয় শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয় তখন তিনি এর তিব্র প্রতিবাদ করেন। দলিয় বৈঠকে যখন প্রায় সকলেই এর পক্ষে বক্তব্য দিচ্ছিল তখন তিনি শেখ মুজিবর রহমানের উদ্দেশ্যে বলেন যে আমরা ইয়াহিয়া খানকে সরিয়ে কোন মুজিব খানকে চাইনা। শেষ পর্যন্ত এপ্রিল মাসে একদলিয় বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি এর প্রতিবাদে সংসদ সদস্য ও দলিয় পদ থেকে পদত্যাগ করেন। বাকশালি শাসন এর প্রতিবাদে তিনিই প্রথম আওয়াজ তুলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট শেখ মুজিবর রহমান নিহত হলে তিনি খন্দকার মুশতাক এর সরকারে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন। ৩রা নভেম্বর খালেদ মুশাররফ এর নেতৃত্বে যে বিদ্রোহ হয় তিনি এই বিদ্রোহ প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। সফল না হলেও যখন শাফায়াত জামিল এর নেতৃত্বে কয়েকজন তরুন অফিসার বঙ্গভবনে বৈঠকরত তৎকালিন মন্ত্রিসভার বৈঠকে অস্ত্র সহ প্রবেশ করে ও গুলি চালানর চেষ্টা করে তখন অকুতভয় জেনারেল ওসমানি নিজের জিবনের ঝুকি নিয়ে
তাদের প্রতিরোধ করেন। এরপর ৭ই নভেম্বর সিপাহি বিপ্লবের সময় তিনি আবারও বঙ্গভবনে যান এবং এবারও দেশকে দঙ্গা হাঙ্গামা ও গৃহুদ্ধের হাত থেকে রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি এ সময় ক্ষমতার অতি কাছে ছিলেন এবং সামান্য চেষ্টা করলেই তিনি রাস্ট্রের সর্বোচ্চপদ অধিকার করতে পারতেন কিন্তু তিনি সেই চেষ্টাও করেননি।
বিচারপতি আবু সাদাত মুহাম্মদ সায়েম এর নেতৃত্ব প্রথমে সরকার গঠিত হয় এবং তার পর জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বে সরকার পরিচালিত হয়। জেনারেল ওসমানি ১৯৭৬ সালে জাতিয় জনতা পার্টি গঠন করেন এবং ১৯৭৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেনারেল জিয়াউর রমানে বিরুদ্ধে আওয়ামিলিগ সহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল সমর্থিত প্রার্থি হিসেবে প্রতিদদ্বিতা করেন। ১৯৮১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও তিনি প্রতিদদ্বিতা করেন সতন্ত্র প্রার্থি হিসেবে। এসময় তিনি সিলেটেই সাধারনত অবস্থান করতেন এবং বিভিন্ন জাতিয় বিষয়ে মতামত ও পরামর্শ দিতেন। ১৯৮৪ সালের ১৬ ই ফেব্রুয়ারি এই মহান যোদ্ধা লন্ডনে ইন্তেকাল করেন। তাকে সিলেটে হযরত শাহজালালের মাজার সংলগ্ন কবরস্থানে দাফন করা হয়।
চিরকুমার জেনারেল ওসমানি ছিলেন একজন অত্যন্ত সৎ ব্যাক্তি। অতি সাধারন জিবনযাপন করতেন তিনি। সৈনিকদের মত ক্যাম্পখাটে ঘুমাতেন। মগে করে চা পার করতেন। সাধারনত গেঞ্জি পাজামা পরে থাকতেন ঘরে। অনুষ্ঠানে শেরওয়ানি বা পাজামা পাঞ্জাবি পরে যেতেন। সিলেটে তার পেনশনের টাকায় ও উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির আয় দিয়ে জিবন কাটাতেন। একটি পুরোন গাড়ি ছিল যা সামরিক বাহিনিতে কর্মরত অবস্থায় কিনেছিলেন।
ব্যাক্তিগত শ্রদ্ধা কখনও তাকে সত্য ও ন্যায়পরায়নপরতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। আবার ব্যাক্তিগত বিরোধও কারো প্রতি প্রাপ্য সন্মান দেয়ায় বাধা দেয়নি।
শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি আমৃত্য শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন কিন্তু তার নিতির প্রশ্নে তিব্র সমালোচনা করেছেন। বিশিষ্ট ও প্রবিন রাজনিতিবিদ রা যখন বাকশালে যোগ দিচ্ছেন কিংবা নিরব থেকেছেন তখন নবিন রাজনিতিক হয়েও ন্যায়ের পক্ষে উচ্চ কণ্ঠে প্রতিবাদ করেছেন এবং সাহসের সাথে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছেন আজিবন গনতন্ত্রের সমর্থক এই ব্যাক্তি। আবার ১৯৭৫ সাল থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমানের সাথে ব্যাক্তিগত পর্যায়ে বিরোধ থাকলেও এবং তার বিপক্ষে নির্বাচনে প্রার্থি হলেও জিয়ার শাহাদাতের পর তিনি তার জানাজার প্রথম সারিতে উপস্থিত থেকেছেন। তাকে কবরে নামানর সময় পাশে ছিলেন এবং প্রথম কবর জিয়ারত করে সামরিক ষ্টাইলে সন্মান প্রদর্শন করেছেন। বাংলাদেশকে স্বাধিন ও সার্বভৈীম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠায় তার অবদান সর্বোচ্চ। কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমানে তিনি যেন হারিয়ে গেছেন নতুন প্রজন্মের সম্মুখ থেকে। স্বাধিনতার সংগ্রাম তো এখন একনেতা ও একদলের ব্যাক্তিগত সম্পত্তি হয়ে গেছে। আর মিডিয়াও এই প্রবল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধি ব্যাক্তিটিকে এখন এড়িয়ে চলতেই ইচ্ছূক কারন জেনারেল ওসমানি তার স্বাধিন মানসিকতার জন্য তৎকালিন ভারত সরকারের চক্ষুশুল ছিলেন। গতকাল তার জন্মদিবস গত হলেও কয়েকটি মাত্র দৈনিক পত্রিকায় ছোট করে এক কলামে এই সংবাদ ছাড়া এই সংক্রান্ত আর কোন খবর নাই। তরুন প্রজন্মের আকর্ষনিয় ব্লগও এই ক্ষেত্রে নিরব দেখে দুঃখ বোধ করছি।

হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা এসেছিল আবার

হ্যামলিনের সেই বাঁশিওয়ালা গতকাল আবার এসেছিল।পার্থক্য শুধু তার হাতে আগে ছিল বাঁশি আর এখন মোবাইল ফোন। সেবার তার কাজের পক্ষে একটা যুক্তি ছিল অন্ততপক্ষে।হ্যামলিনের মেয়র চুক্তি মোতাবেক তার প্রাপ্য দিতে চাননি।কিন্তু এবার কোন মেয়রের দোষে সে এতগুলি কচি প্রান ছিনিয়ে নিয়ে গেল তা হয়তোবা আর জানা যাবেনা।
এই কিশোরেরা স্ব-ইচ্ছায় এই মিনি ট্রাকে চড়ে তাদের স্কুলের প্রাইমারি সেকশনের খেলা দেথতে গিয়েছিল কিনা তা জানা যাবে কি? পিকনিক এর মত এই ভ্রমন এ কিশোরদের অনিচ্ছা থাকার কথা নয়। হয়তোবা তাদের ছোটভাইদের মধ্যে তারা দেখতে গিয়েছিল ভবিষ্যতের কোন মেসি কিংবা ম্যারাডোনা কে। কিন্তু ফিরে আসার সময় হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা তার মোবাইল ফোন বাজিয়ে তাদের কে নিয়ে গেল অন্য জগতে।তবে তার আচরনের একটা পরিবর্তন হয়েছে এবার। আগেরবার সে সব বাচ্চাদের নিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এবার তাদের প্রানগুলি নিয়ে গিযে শুধূ নিস্প্রান দেহটা ফিরিয়ে ধিয়েছে।পৃথিবীর সবচেয়ে ভারি বোঝা করে পিতা-মাতার কাঁধে। কেন হঠাত করে তারা এই প্রান নিয়ে যাওয়ার শখ হলো। আমরা হয়তোবা আর কোনদিন জানতে পারবোনা।

প্রতিবছরের মতই এবার ও স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট হচ্ছে। প্রত্যেকটি উপজেলা-থানা শিক্ষা অফিস থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে স্কুলের ছাত্র-ছ্রাত্রি উভয়ের ফুটবল টিম গ্রঠন করে খেলার জন্য নিয়ে যেতে। সেই সঙ্গে বাকি শিক্ষার্থিদেরও দর্শক বা সমর্থক হিসেবে নিয়ে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোন পরিকল্পনা বা অর্থ বরাদ্দ নাই। নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব সেই স্কুল কর্তৃপক্ষের। সল্প বেতনের যে শিক্ষকরা প্রায়ই ব্যার্থ হন নিজের সন্তানদের শিক্ষা দিতে সেখানে তাদের কে নিজর পয়সা খরচ করে এই কাজ করতে বলা হয়।উপজেলা,জেলা অফিসের চেয়ারে বসে থাকা আমলা শ্রেনীর শিক্ষা অফিসার এই নির্দেশগুলিকে তার ক্ষমতা দেখানোর উপায় হিসেবেই দেখেন।অন্য অফিসারদের তুলনায় না হলে তার ক্ষমতাকম মনে হবে যে!
হয়তোবা এই ঘটনার তদন্ত হবে। ট্রাক ড্রাইভারের সার্থে দায়িত্বহীনতার অভিযোগে চাকুরি হারাবেন স্কুলটির নিরিহ শিক্ষকরা। কিন্তু আড়ালে রয়ে যাবেন সেই ক্ষমতাধর কর্মকর্তরা যারা কোন পরিকল্পনা ব্যাতিরিকে উদ্ধট আদেশ–নির্দেশ দিয়ে যান।

নিজেকে অপরাধী মনে হয় যে মোবাইল ফোনের কারনে এই দুর্ঘটনা আমি সেই প্রযুক্তির সাথেই যুক্ত। কোম্পানীগুলি বিজ্ঞাপনের জন্য যে পরিমান ব্যায় করে তার একটি অংশ কি ব্যায় করতে পারতোনা মোবাইল ফোন ব্যবহার বিধির উপর জনসচেতনতায়। শুধু নারীদের নৃত্যই কেন বিজ্ঞাপনের বিষয়।

এই শহিদদের জন্য আমরা এখন শুধূ মাগফিরাতই কামনা করে যাব আর ভুলে যাব দুদিন পরই। শুধু ভুলতে পারবেননা সেই পিতা নিজের কাঁধে যিনি বহন করেছেন সন্তানের লাশ।

জেরুসালেম এর চারটি ঐতিহাসিক দিন।

১. মাস,এপ্রিল,৬৩৭ সাল।আরবের তপ্ত মরুর বুকে পথ চলে কেবল একজন সহযাত্রি সেবক কে নিয়ে জেরুসালেম শহরের উপকণ্ঠের মুসলিম বাহিনীর ঘাঁটিতে উপস্থিত হলেন হযরত উমর (রাঃ)।অবরুদ্ধ জেরুসালেম এর নেতৃবৃন্দ কেবল মাত্র খলিফার সাথেই সন্ধি চুক্তি সাক্ষর ও আত্মসমর্পন করার শর্ত দিয়েছেন। যুদ্ধ করে জেরুসালেম দখল করা মুসলিম বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হলেও রক্তপাত এড়ানোর জন্য এই তপ্ত মরুর মধ্যে দিয়ে সাত-আটদিন চলে হযরত উমর (রাঃ)জেরুসালেম এর নেতৃবৃন্দের শর্তানুযায়ি এসেছেন।উমর(রাঃ)জেরুসালেম এর নেতৃবৃন্দের সাথে সন্ধিচুক্তিতে সাক্ষর করলেন এবং শহরের চাবি তার হাতে স্থানান্তরিত করা হলো। সন্ধির শর্ত অনুযায়ি সকল ধর্মের অধিবসিকে জেরুসালেমে বসবাসের অধিকার ও নিরাপত্তা প্রদান করা হলো। কেউ যদি শহর ত্যাগ করতে চায় তবে তার সম্পদ সহ ত্যাগ করার অধিকার দেয়া হলো। সকল ধর্মস্থান নিজনিজ ধর্মের নিয়ন্ত্রনে থাকলো। অমুসলিম দের উপর শুধূমাত্র জিযয়া কর আরোপ করা হলো। তাও কেবল মাত্র সমর্থ পুরুষ মানুষদের উপরে। বিজয়ি মুসলিম সৈন্যরা শান্তি ও নিরবতার সাথে শহরে প্রবেশ করল।হযরত উমর (রাঃ)শহর পরিদর্শন করতে গেলেন।খৃষ্টান ধর্মনেতাদের আমন্ত্রনে তিনি ”চার্চ অফ রেসারেকশন”নামের শহরের প্রধান গির্জা পরিদর্শন করছিলেন।এমন সময় নামাজের সময় হলো।খৃষ্টান ধর্মনেতা প্যাট্রিয়ার্ক সোফার্নিয়াস তাকে গির্জার ভিতরেই নামাজ পড়ার আমন্ত্রন জানালেন। কিন্তু উমর(রাঃ)বাইরে গিয়ে উঠানে নামাজ আদায় করলেন।বিস্মিত সোফার্নিয়াস এর কারন জানতে চাইলে হযরত উমর(রাঃ)জবাব দিলেন যে তিনি যদি গির্জার ভিতরে নামাজ পরতেন তাহলে একে মুসলিমরা গির্জার মধ্যে নামাজ পড়ার জন্য খলিফা অনুমতি দিয়েছেন বলে ধরে নিতে পারত এবং এত সন্ধির শর্ত ভঙ্গ হবে। অন্যদিকে এই যুক্তিতে পরবর্তিতে মুসলিমরা গির্জাটিকে মসজিদেও পরিবর্তিত করতে পারে। এই ছিল সন্ধির মর্যাদা এবং শুধু রক্তপাত এড়ানোর জন্যই খোদ খলিফা মরুভুমির মধ্যে দির্ঘ সফর করেছিলেন।

২.১৫ই জুলাই,১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দ। খ্রিষ্টান ক্রুসেডারদের হাতে অবরুদ্ধ জেরুসালেম আত্মসমর্পন করল এই শর্তে যে সকল মুসলিম ও অন্য ধর্মাবলম্বিদের নিরাপদে শহর ত্যাগ করতে দেয়া হবে। দুপুরে খ্রিষ্টান নেতা গডফ্রে দ্য বুইলোঁ প্রবেশ করলেন শহরে। আর প্রবেশ করেই আদেশ দিলেন শহরের সকল মুসলিম ও ইহুদি অধিবাসিদের হত্যা করতে। তিনদিন ধরে চলল এই রক্তের খেলা। শহরের সত্তর হাজার মুসলিম ও ইহুদি এবং কিছু সংখ্যক ভিন্নমতাবলম্বি খ্রিস্টানদেরও হত্যা করা হলো। আল-আকসা মসজিদ, উমর মসজিদ, এমনকি খ্রিষ্টান ধর্মিয় পবিত্রস্থানে আশ্রয়ে নেয়া সকল মুসলিমকে,নারী,শিশু,বৃদ্ধ নির্বিশেষে হত্যা করা হলো। একজন ক্রুসেডার "জেষ্টা ফানকোরাম" এর লেখায় রয়েছে টেমপল মাউণ্ট যা হযরত সুলায়মান (আঃ)কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এবং সকল ধর্মেই পবিত্র স্থান বলে স্বিকৃত সেখানে এতবেশি লোককে হত্যা করা হয়যে তার মেঝেতে ক্রুসেডারদের হাঁটু পর্যন্ত রক্ত জমে যায়। এই বিশ্বাসঘাতকতা ও হত্যা কে ক্রুসেডে অংশগ্রহনকারীদের জন্য পাপ নয় বলে ঘোষনা দেন স্বয়ং পোপ।

৩.২রা অক্টোবার,১১৮৭ খ্রিস্টাব্দ। ৮৮ বছর পর জেরুসালেমের উপকন্ঠে পেীছেছে গাজী সালাহউদ্দিন এর নেতৃত্বাধিন মুসলিম বাহিনী। শহরের অধিনায়ক বেলিয়ান অফ ইবলিন আত্মসমর্পনের জন্য আলোচনা করতে আসলেন। মুক্তিপন দেয়ার শর্তে সকল অধিবাসিকে নিরাপত্তা দেয়ার কথা দিলেন সালাহউদ্দিন। আত্মসমর্পন করল জেরুসালেম।সালাহউদ্দিন এর নেতৃত্বে শহরে প্রবেশ করল মুসলিম বাহিনী। খৃষ্টানরা ভয় পাচ্ছিল সালাহউদ্দিন তাদের মত সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করেন কিনা। কিন্তু না। শান্ত,সু-শৃঙ্খলভাবে মুসলিম বাহিনী প্রবেশ করল শহরে। একজন অধিবাসির গায়েও হাত তোলা হয়নি সেদিন। যারা মুক্তিপন দিতে পেরেছে তাদেরকে তাৎক্ষনিক মুক্তি দেয়া হয়েছে।যখন কেবলমাত্র দরিদ্ররা অবশিষ্ট থাকল তখন সালাহউদ্দিন নিজের সম্পদ থেকে তাদের মুক্তিপন আদায় করে সকলকে মুক্তি দিয়ে দিলেন।
৪.১১,ডিসেম্বর,১৯১৭। ৯ই ডিসেম্বর ১৯১৭ সালে জেরুসালেম এর মেয়র বে আল হুসাইনি জেরুসালেম এর আত্ম সমর্পনের দলিলে সাক্ষর করেন। গাজী সালাহউদ্দিন কর্তৃক জেরুসালেম বিজয়ের পর আবার খৃষ্টানদের দখলে চলে গেল জেরুসালেম। যদিও জেরুসালেম দখলকারী মিত্রবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত ছিল শরিফ আল হুসাইন এর নেতৃত্বাধিন আরব মুসলিম সৈন্যদল যাদের কে তুর্কি শাসন হতে মুক্তি দেয়ার এবং জেরুসালেম কে তাদের নিয়ন্ত্রনে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে খিলাফতের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করতে ষড়যন্ত্রের ফাঁদে ফেলেছিলেন ইংরেজ টি.ই লরেন্স। ১১,ডিসেম্বর ১৯১৭ সালে দুপুর বেলা মিত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক বৃটিশ জেনারেল লর্ড এলেনবি তার সহযোগি ফ্রান্স,যুক্তরাষ্ট্র,ও ইতালিয় সামরিক কমান্ডার দের সাথে খালি পায়ে প্রবেশ করেন জেরুসালেমে। নগরীর জাফা গেইট অতিক্রম করে তিনি এর মাটিতে চুম্বন করেন এবং বলেন যে আজকে ক্রুসেড এর সমাপ্তি ঘটল।এলেনবি পবিত্র স্থানগুলি রক্ষায় প্রহরী হিসেব বৃটিশ ও স্কটিশ সৈন্যদের নিয়োজিত করেন। শুধু ইহুদি ধর্মাবলম্বিদের জন্য নিযুক্ত করা হয় বৃটিশ সেনাবাহিনির ইহুদি সৈনিক দের নিয়ে গঠিত বাহিনি ”জিউইশ লিজিয়ন” এর সৈন্কি দের।কিন্তু তার সাথি আরবদের কোন অধিকার না দিয়ে তাদেরকে প্রেরন করেন সম্মুখবর্তি ফ্রন্টে। আর জেরুসালেম কে শরিফ হুসাইন এর নিয়ন্ত্রনে দেয়ার পরিবর্তে তাকে মুসলিম ও ইহুদি দুই ভাগে বিভক্ত করে মুসলিম অংশের নিয়ন্ত্রন রাখেন নিজের হাতে আর ইহুদি অংশের নিয়ন্ত্রন দেয়া হয় ইউরোপিয় ইহুদিদের হাতে।আর সকল মুসলিম সমর্থবান পুরুষদের আটক করে পাঠান হয় বন্দিশিবিরে। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারগুলির সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়।

এই চারটি দিনের ঘটনাগুলির বৈপরিত্ত কি আমাদের চোখ খুলে দেয়না? জানায় না কারা প্রকৃতপক্ষে মানবতাবাদী।

ইবনে আল নাফিস। প্রথম মুসলিম সাইন্স ফিকশন রচয়িতা

বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী ইবনে নাফিসের জন্ম ১২১৩ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়ার দামেস্ক। তার পুর্ন নাম আলা আদদিন আবু আল হাসান আলি ইবনে আবি হাজামম আল কুরায়শি আল দামেস্কি। ইবনে নাফিস তার কুনিয়াত বা ডাকনাম। তিনি দামেস্ক এর হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে শিক্ষা লাভ করেন।চিকিৎসার পাশাপাশি তিনি আল-কুরআন,হাদিস,সাহিত্য,দর্শন,ফিকহ এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিজ্ঞান সমুহ সম্পর্কেও উচ্চমানের শিক্ষা অর্জন করেন। ১২৩৬ সালে ইবনে নাফিস কায়রো চলে যান এবং কায়রোর আল-নাসিরিয়া এবং আল-মানসুরিয়া হাসপাতালে কাজ করেন। যেখানে তিনি প্রধান চিকিৎসক এর পদ লাভ করেন। কায়রোতে কর্মরত থাকা অবস্থায় ১২৫৮ সালে হালাকু খান বাগদাদ ধ্বংস করেন এবং ইবনে নাফিসের জন্ম স্থান সিরিয়া ও দখল করেন। তৎকালীন জ্ঞান বিজ্ঞানের কেন্দ্রস্থল বাগদাদ ধ্বংস করার সময় হালাকু খান সকল বইপত্র পুড়িয়ে দেন এবং জ্ঞানী বক্তিদের হত্যা করেন। ইবনে নাফিস এই ধ্বংসের হাত থেকে জ্ঞান বিজ্ঞানের অমুল্য সম্পদ রক্ষার জন্য তৎকালীন অন্যান্য মুসলিম মনিষির ন্যায় তার জানা সকল বিষয়কে লিপিবদ্ধ করে বিশ্বকোষ প্রনয়ন করেন।১২৮৮ সালে তিনি কায়রোতে ইন্তেকাল করেন। তিনি কায়রোর সুলতান বাইবার্স এর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন।
বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী ইবনে নাফিস ছিলেন একই সঙ্গে চিকিৎসক,জীববিজ্ঞানী,সাহিত্যিক,হাদিস বিশারদ এবং ফিকহবিদ। রক্ত-সংবহন ও স্নায়ুতন্ত্র বিষয়ে তার মতামত এখনও গুরুত্বপুর্ন রয়েছে। সার্জারীর ক্ষেত্রেও তিনি নতুন নিয়ম এর আবিস্কার করেন। মনরোগ চিকিৎসা এবং মনোবিজ্ঞান বিষয়ে তিনি ছিলেন একজন পথিকৃত। চোখ এবং আলোক বিজ্ঞান বিষয়েও অনেক মেীলিক তথ্যের আবিস্কার করেছিলেন ইবনে আল নাফিস। চিকিৎসা সংক্রান্ত কিছু ল্যাটিন গ্রন্থের অনুবাদ ও তিনি করেন। খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান সম্পর্কেও ইবনে নাফিস গ্রন্ত রচনা করেছেন। কোন ওষুধ প্রয়োগ না করে খাদ্যাভাস নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে চিকিৎসা করার ব্যাপারে ইবনে নাফিস বিশেষ আগ্রহি ছিলেন এবং কিছূ ক্ষেত্রে এর সফল প্রয়োগ করতে ও তিনি সক্ষম হয়ে ছিলেন। তিনি ওষুধ হিসেবেও মদ ব্যবহার করার বিরোধি ছিলেন এবং মদের অপকারিতা বিষয়েও গবেষনা করেন।
ইবনে নাফিস হাদিস গবেষনার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ মতবাদের সৃষ্টি করেন। তিনি হাদিস সহি বা যইফ নির্ধারনের জন্য হাদিসটির ইসনাদ বা পরম্পরা বিবেচনার সাথে হাদিসটির যুক্তিযুক্ততা বিচারের পদ্ধতি অবলম্বনের পক্ষে ছিলেন। তিনি সহি ও যইফ এই দুটি ভাগ থেকে যুক্তির ভিত্তিতে আরো দুই ভাগে বিভক্ত করেন। তার এই শ্রেনী বিভাগ ছিল যেই হাদিস যুক্তি এবং সনদ উভয়এর দিক দিয়ে শক্তিশালি তা অব্যশই সহি,এবং কোন হাদিস যদি যুক্তি বিচারের অগ্রহনীয় হয় তাহলে তা হয়তো বা সহি। অন্যদিকে যইফ হাদিস ও এভাবে যুক্তি বিচারে অবশ্যই যইফ এবং হয়তো বা যইফ ইবনে নাফিস হাদিস শাস্ত্রে এই পদ্ধতি প্রয়োগের সমর্থক ছিলেন। ইবনে নাফিস বিশ্বাস করতেন যে রাসুল সাঃ এর সুন্নত এর সঠিক অনুসরন করতে ব্যর্থতাই মুসলিম সমাজের পতনের কারন। মুসলিম সভ্যতার পতন রোধের উদ্যেশ্যে ইবনে নাফিস তরুনদেরকে সুন্নতে রাসুলুল্লাহ(সাঃ)এর অনুসরনে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন এবং তিনি সুন্নতে রাসুল এর অন্তর্ভুক্ত আচরন সমূহের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রদান করেন।

বাগাদাদের পতনের পর তিনি রচনা করেন আরবী সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রথম দিকের মেীলিক উপন্যাস "আল রিসালাহ আল কামিল ফি সিরাতিল নবী" । তার নিজের বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক মতবাদের প্রকাশ করাও এই উপন্যাস রচনার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। তিনি ১২৬৮ থেকে ১২৭৭ সালের মধ্যে এই গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থটির নামের অর্থ হচ্ছে ”নবীর সিরাত বা জীবন এর উপর কামিলের থিসিস কিংবা পর্যবেক্ষন"গ্রন্থটি ”রিসালায়ে ফাদিল বিন নাতিক” নামেও পরিচিত।
উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র কামিল। কামিল একটি মরুদ্বিপে জন্ম নেয়্ এক কিশোর যে পিতা-মাতাহিন অবস্থায় কৈশোরে উপনিত হয়। কামিল একটি স্বশিক্ষিত চরিত্র যার সাথে এই দ্বিপের বাইরের পৃথিবীর কোন পরিচয় নেই। জাহাজডুবির ফলে দ্বিপে আশ্রয় নেয়া নাবিকরা তাকে সভ্য দুনিয়ায় নিয়ে আসে এবং কামিল তার যুক্তিবোধ এবং ইনটুইশন এর দ্বারা এই পৃথিবীর বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে।
ইবনে নাফিসের এই উপন্যাস প্রাথমিক কল্পবিজ্ঞান রচনার একটি অন্যতম উদাহরন। এই উপন্যাসে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সত্য কে তার কাল্পনিক ব্যবহার দ্বারা ব্যখ্যা করা হয়েছে। ইবনে নাফিস তার এই রচনাটিকে বলেছেন ইসলামকে বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিগতভাবে রক্ষার চেষ্টা বলে। মানুষের দৈহিক পুনুরুথান এবং কিয়ামতের বিযয়ে তিনি কল্পনার আশ্রয় নিয়ে যে চিত্র উপস্থাপন করেছেন তাই এই রচনা টিকে একটি কল্পবিজ্ঞানের প্রাথমিক উদাহরন এ পরিনত করেছে। যদিও ইবনে নাফিসের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল এই রচনার মাধ্যমে ইসলামের মৈীলিক আদর্শকে তুলে ধরা এবং ইসলামের বিশ্বাস সমুহকে বৈজ্ঞানিক ভাবে ব্যখ্যা করা। ইবনে নাফিস ছিলেন ইসলামি সভ্যতা ও বিজ্ঞানের একজন প্রধান বিশেষজ্ঞ এবং সেই সংগে একজন পরিপুর্ন ইসলাম ধর্ম অনুসারি। পতন এবং বিকৃতির মুখোমুখি ইসলামি সভ্যতা এবং ধর্ম কে রক্ষা এবং বিভ্রান্ত তরুন সমাজকে সঠিক পথের দিশা দিয়েছিলেন তিনি। পাশাপাশি বিজ্ঞান বিশেষত শরিরবিজ্ঞান বিষয়ে তিনি ছিলেন প্রথম আধুনিক গবেষেক যার গবেষনা এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব্ কিছূ ছাড়াও তিনি পৃথিবীর অন্যতম প্রথম এবং প্রথম মুসলিম সাইন্স ফিকশন রচয়িতা হিসেবেও চির স্মরনিয়।

আমাদের দেশের কয়েকজন শিকারি ও শিকার কাহিনি।

শিকার কাহিনি পড়তে ভালবাসেন এমন লোকের সংখ্যা কম নয়। শিকার কাহিনির উত্তেজনা এবং থ্রিল ড্যান ব্রাউন কিংবা আয়ান ফ্লেমিং এর লেখা গল্প-উপন্যাস থেকে কম নয়। অন্যদিকে শিকার কাহিনি সত্য ঘটনা। সেই সঙ্গে জ্ঞান বৃদ্ধিও করে। আমাদের দেশে অনেকই শিকারী হিসেবে চিনেন জিম করবেট আর কেনেথ এন্ডারসনকে। এরা শিকার করেছেন যথাক্রমে উত্তর ও দক্ষিন ভারতে। কিন্তু আমাদের বর্তমান বাংলাদেশেই যে একসময় মাত্র ৩০-৪০ বছর আগেও প্রচুর শিকার এর ঘটনা আছে এবং সেগুলিও বিদেশি শিকারিদের কাহিনি থেকে কম আকর্ষনিয় নয়। আমাদের দেশিয় শিকারীদের রোমহর্ষক কাহিনির কয়েকটি বইও আছে। আমাদের দেশের কয়েকজন সাহসি শিকারি ও তাদের শিকার জিবনের কিছু পরিচিতি দেয়ার চেষ্টা করছি।

১.সুন্দরবনের মানুষ খেকো।-পচাব্দি গাজী। অনু লেখনে হুমায়ুন খান।
বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ শিকারি হিসেবে পচাব্দি গাজীর নাম অনেকেই শুনেছেন। পচাব্দি গাজীর আসল নাম আবদুল হামিদ গাজী। সুন্দরবনের প্রান্তে সাতক্ষিরা জেলার শ্যামনগর থানায় তার পৈতৃক বাড়্ী। তারা বংশানুক্রমে শিকারি। তিনি প্রায় ৬০ টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও পচিশটি কুমির শিকার করেছেন প্রায় পঞ্চাশ বছর বিস্তৃত তার শিকার জীবনে। এর মধ্যে বিশটির বেশি ছিল ভয়ংকর মানুষখেকো। এই বইটিতে পচাব্দি গাজীর সাতটি মানুষখেকো বাঘ শিকারের কাহিনি রয়েছে। আর একটি অধ্যায় রয়েছে সুন্দরবনের পরিবেশ ও প্রানিদের নিয়ে লেখা এবং অন্য একটি অধ্যায় আছে পচাব্দি গাজীর শিকারি জিবনের কিছু উল্লেখ যোগ্য ঘটনা। যার মধ্যে আছে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও নেপালের রাজা মহেন্দ্রর সাথে তার শিকারের কাহিনী। মানুষখেকো বাঘ শিকারের কাহিনী গুলির মধ্যে গোলখালির বিভিষিকার কাহিনীটি অত্যন্ত মর্মস্পর্শি। এই বাঘটির হাতে নিহত হন পচাব্দি গাজীর ছোটদাদা অর্থাত তার বাবার চাচা ইসমাইল গাজী । তার বাবা মেহের গাজী মারাত্মক আহত হন এবং চাচা নিজামদি গাজী তার এক হাত হারান। তথাপি শেষ পর্যন্ত পচাব্দি গাজী এই বাঘটি শিকার করতে সমর্থ হন। এটি ছিল তার প্রথম মানুষখেকো বাঘ শিকার। পচাব্দি গাজীর শিকার জীবনের ১৯৭১ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য শিকারের ঘটনাগুলি সংকলিত হয়েছে এই বইয়ে। ১৯৭১ সালের পরেও তিনি দুয়েকটি মানুষখেকো বাঘ শিকার করেছিলেন। এই বইটির অনু লেখক সাংবাদিক-সাহিত্যক হুমায়ুন খান সরাসরি পচাব্দি গাজীর মুখ থেকে শুনে এই বই যের ঘটনাগুলি লেখেছেন। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় সেবা প্রকাশনি থেকে সুলভ সংস্করন হিসেব। এরপর খান ব্রাদার্স থেকেও বইটির হোয়াইট প্রিন্ট সংস্করন প্রকাশিত হয়। বর্তমানে প্রজাপতি প্রকাশনি থেকে বের হওয়া হোয়াইট প্রিন্ট সংস্করন টি পাওয়া যায়। তবে এটিও খুব কম দোকানেই আছে। আগ্রহিরা বাংলা বাজার কিংবা সেগুনবাগিচায় সেবা প্রকাশনির শো-রুম ও অফিসে খোজ নিয়ে দেখতে পারেন। সুন্দরবন এবং এর রাজা রয়েল বেঙ্গল টাইগার সম্পর্কে যারা আগ্রহী তাদের জন্য এই বই অবশ্যপাঠ্য। শহুরে তথাকথিত গবেষক বা প্রানি প্রেমিদের তুলনায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার সম্পর্কে সুন্দরবনের প্রান্তে বসবাসকারী পুরুষানুক্রমে শিকারী পচাব্দি গাজী অনেক বেশি জ্ঞান রাখেন। পচাব্দি গাজীর শিকারের খ্যাতি পাকিস্তান আমলেই দেশে ও দেশের বাইরে বিস্তৃত হয়। তাকে প্রথম মিডিয়ায় পরিচিত করে তুলেন সাংবাদিক মরহুম তোহা খান। পাকিস্তান আমলে একবার টেলিভিশনে তার সাক্ষাতকার প্রচারিত হলেও পরে আর কোন টিভি রেকর্ড সম্ভবত তার নাই। বাংলাদেশ আমলে তার নাম লোকে প্রায় বিস্মৃত হয়ে যান। কিছূ তথাকথিত প্রানি প্রেমিকের অদ্ভুদ দাবিকে মান্য করে সরকার বৈধ শিকার পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে দেন তবে চোরা শিকার বনবিভাগের কর্মকর্তাদের সহয়তায় এখনও জারি আছে। সেই সঙ্গে বিখ্যাত শিকারিরাও হারিয়ে যান মানুষের মন থেকে। একদিকে চোরা শিকার ও বন কেটে লোক বসতি বিস্তারের কারনে সুন্দরবনে বাঘের আবাসস্থল কমে যাচ্ছে। অন্য দিকে একই কারনে খাদ্যের অভাব হওয়ায় বাঘ তার স্বাভাবিক খাদ্য ছেড়ে মানুষ খেকো হয়ে উঠছে। আর এই মানুষখেকো গুলি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে আমলাতান্ত্রিক দির্ঘ সুত্রিতার কারনে এগুলিকে মারা যাচ্ছেনা। আর অন্যদিকে মানুষখেকো বাঘের অত্যাচারে বিরক্ত মানুষেরা পিটিয়ে বা বিষ প্রয়োগ করে মেরে ফেলছে কিছু নিরিহ বাঘকেও। পচাব্দি গাজীর কোন উত্তরাধিকারি শিকারি থাকলে হয়তো এভাবে অপ্রয়োজনিয় বাঘ হত্যা এড়ানো যেত।

২.”শিমুলতলার নরখাদক”,”মানিগার নরখাদক”,”জানোয়ারের খাস মহল”।-আবদুর রহমান চেীধুরি।
সুনামগঞ্জের সেলবরষ এর জমিদার পরিবারের সন্তান ছিলেন আবদুর রহমান চেীধুরি। তিনি ৪৯ বেঙ্গলিজ রেজিমেন্ট এ যোগদেন এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। এ সময় তার সহকর্মি ছিলেন জাতিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। পারিবারিক ভাবেই শিকারের দিকে ঝোঁক ছিল তার। তিনি এক ডজনের মত বাঘ শিকার করেছেন। এর মধ্যে কয়েকটি ছিল মানুষখেকো এবং বাকিগুলিও লোকালয়ে উৎপাতকারী বাঘ। এই বাঘ শিকারের ঘটনাগুলি তার নিজের লেখায়ই পঞ্চাশের ও ষাটের দশকে দৈনিক আযাদ, মাহে নও প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরবর্তিতে মুক্তধারা প্রকাশনি থেকে তার শিকার কাহিনি নিয়ে তিনটি বই ”জানোয়ারের খাস মহল”,”শিমুলতলার নরখাদক”ও ”মানিগার নরখাদক” প্রকাশিত হয়। তিনি সর্বশেষ বাঘ শিকার করেন ১৯৫৫ সালে। তার লেখা অত্যন্ত সুখপাঠ্য। ”শিমুলতলার নরখাদক” বইটিতে একটি মানুষখেকো বাঘের বিবরন দেয়া হয়েছে যে বাঘটি অলেীকিক শক্তির অধিকারি ও অবধ্য বলে পরিচিত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত দক্ষ শিকারি আবদুর রহমান চেীধুরির হাতে বাঘটির মৃত্য হলেও লোকজন সেটাকেও একটি অলেীকিক কান্ডে পর্যবসিত করেছিল যা পড়ে পাঠকরা বেশ কেীতুক অনুভব করবেন। দুঃখ ও দুর্ভাগ্যের কথা হচ্ছে তিনি যে বনে এই বাঘগুলি শিকার করেছিলেন সেই বন তার জিবিতকালেই সম্পুর্ন ধ্বংস হয়ে গেছে। সিলেট ও সুনামগন্ঞ্জের উত্তরে প্রায় পাচশত বর্গমাইল জুড়ে থাকা এই বনাঞ্চল সিলেট ও সুনামগঞ্জকে মেঘালয় থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের হাত থেকে রক্ষা করত। এই বনাঞ্চল ধ্বংসের কারনে এখন প্রতি বছর সুনামগঞ্জ এলাকায় বন্যা ও ঢলে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ২০০৪ সালে এই পাহাড়ি ঢলের তিব্রতা ও ধ্বংসকারী শক্তি আমি(ব্লগ লেখক) নিজে প্রত্যক্ষ করেছি। তিনি কখনই অযথা কোন বাঘ শিকার করেননি। শুধূমাত্র মানুষখেকো ও লোকালয়ে উৎপাতকারি বাঘ শিকার করেছিলেন। বর্তমানে তাহিরপুর,জামালগঞ্জ ও ধর্মপাশা উপজেলা অঞ্চলে বিস্তৃত লাউর ও মাহরাম পরগনা নামে পরিচিত এই বনাঞ্চল ষাটের দশক থেকেই কাটা শুরু হয় এবং আশির দশকে পুরোপুরি নিশ্চিন্হ হয়ে যায়। আবদুর রহমান চেীধুরির লেখা বইগুলির সম্পদক খলিল চেীধুরি বইগুলির শেষে এই ধ্বংসকান্ডের বিস্তারিত বিবরন দিয়েছেন। একজন শিক্ষিত ও দক্ষ শিকারি আবদুর রহমান চেীধুরি ষাটের দশকের পর আর শিকার করেননি উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায়। ১৯৮০ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। তার বইগুলি এখন খুব দুস্প্রাপ্য।
৩.যখন শিকারি ছিলাম-এনায়েত মাওলা
এনায়েত মাওলা একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা। চট্টগ্রাম বন্দরে ১৯৭১ সালে নেী কমান্ডো অপারেশন এ তার বিশেষ অবদান আছে। একসময় কাঠ ও ফার্নিচার শিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন। তার আগে চাকরি করতেন রেডিওতে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাঘ ও হাতি সহ বেশ কিছু শিকার করেছেন। কাপ্তাই বাধ তৈরির সময় বাধের পানি ভরার এলাকা থেকে গাছ কেটে নেয়ার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ১৯৫০ সালে তিনি প্রথম যে চিতাবাঘ টি শিকার করেছিলেন তার কথা এখন হয়তো অনেকে বিশ্বাস করবেননা। কারন তিনি এই বাঘটি শিকার করেছিলেন বর্তমান বিমান বন্দরের কাছে এক জায়গায়। যেখানে এখন বাঘ দুরে থাক কাক ছাড়া আর কিছু নাই। আর সেখানে এখন জঙ্গল গাছপালার নয় ইট-কংক্রিটের। সেসময় তার এই শিকারের কথা রেডিওতে প্রচারিত হয়েছিল এবং পত্রিকাতেও এসেছিল। আরেকটি বাঘ শিকারের কাহিনীও আমাদের মত নতুন প্রজন্মের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে। কারন এই ঘটনাটি ছিল বর্তমান মিরপুরে। এনায়েত মাওলার এই বইটির "লেখকের কথা" অধ্যায়ে এই ঘটনা দুটি আছে। তিনি বাংলাদেশের প্রধান শিকারের এলাকা সুন্দরবন,পুর্ব সিলেট এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে শিকার করেছেন। তার বইটিতে সিলেটের শিকার নিয়ে চারটি,চট্টগ্রাম অঞ্চলের শিকার নিয়ে চারটি এবং সুন্দরবনের দুটি কাহিনী আছে। শিকার ছাড়াও এখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের গহিন অরন্য থেকে কাঠ আহরন সহ বিভিন্ন ঘটনা ও স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে একটি উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে শঙ্খ নদীর উজানের দিকে তার অভিযানের ঘটনা। তার বইটিতে বর্নিত এলাকাগুলির মধ্যে শঙ্খ নদির উজানের যে বর্ননা তিনি দিয়েছেন এখনও অনেকটা তা অটুট আছে। সুন্দরবন ছাড়া অন্যান্য অঞ্চলে এখন আর বেশি বন-জঙ্গল নেই। রত্না ও সাগরনাল চা বাগানের যে এলাকায় শিকারের কথা তিনি লিখেছেন তার কাছেই অবস্থিত মাধবকুন্ড এখন বিভিন্ন টুরিস্ট স্পট ও লোক বসতি তৈরি হয়ে আগের বিস্তৃত বন আর নাই। এই বইটির আরেকটি বিশেষত্ব দুটি হাতি শিকারের কাহিনী। আমেরকিান জেনারেল ভ্যান ফ্লিট এর শিকার করা যে বাঘটির কথা আছে সেটাই সিলেট অঞ্চলের রেকর্ড করা শেষ বাঘ অর্থাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখা যাওয়ার রেকর্ড। এরপর সিলেটে আর বাঘ দেখা যায়নি। চট্টগ্রামের শেষ রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখা যাওয়ার রেকর্ড আছে ১৯৮১ সনের।
বইটির শুরুতে কয়েকটি ছবি আছে লেখকের ও প্রকৃতির যা বইটির আকর্ষন আরো বৃদ্ধি করেছে। বইটি প্রকাশ করেছে সাহিত্য প্রকাশ। এনায়েত মাওলা আরো কিছু শিকার করলেও তার উল্লেখযোগ্য সব শিকার কাহিনিই এই বইটিতে আছে।

৪.চট্টগ্রামের শিকার কাহিনি। এরশাদউল্লাহ খান।
এরশাদউল্লাহ খান বাংলাদেশ ব্যাংক এর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এই বইটি চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শিকারের ঘটনা গুলি সংগ্রহ। লেখক নিজেও একজন শিকারি। বইটির বিশেষত্ব হচ্ছে তুলনামুলক বর্তমান কালের শিকারের ঘটনার বিবরন। তবে বৃটিশ আমলের শিকারের কাহিনিও এতে আছে। আছে চুনতি অভয়ারন্য সম্পর্কে একটি অধ্যায়। খান বাহাদুর কবিরউদ্দিন আহমদ এর লেখা নিজের শিকারের কাহিনী একটি আলাদা অধ্যায় হিসেবে রয়েছে। রয়েছে চট্টগ্রাম অঞ্চলের কয়েকজন বিশিষ্ট শিকারী রশিদুল্লাহ খান, ইসরাইল খান(সরকারি কর্মকর্তা,কবি সুফিয়া কামালের দেওর),চুনতির বিশিষ্ট ব্যাক্তিত্ব হাজি সৈয়দ সাহেব, অধ্যাপক হাবিবুর রহমান(পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন) সহ কয়েকজন শিকারির অভিজ্ঞতার বিবরন। দক্ষিন চট্টগ্রামের পাহাড়ি অরন্যের বিবরন খুবই আকর্ষনিয় মনে হবে পাঠকের কাছে। জীবন প্রকাশনি হতে প্রকাশিত বইটি আকারে ছোট হলেও চট্টগ্রাম অঞ্চলের শিকার কাহিনী ও পুরনো আমলের প্রধান শিকারিদের সম্পর্কে জানার একমাত্র উৎস এখনও পর্যন্ত। ছোট ছোট শিকার কাহিনি গুলি ছাড়াও চুনতি অভয়ারন্য নিয়ে লিখা অধ্যায়টিতে এ অঞ্চলে পরিবেশ ও পর্যটন সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। একদিকে বৈধ শিকারের উপর নিষেধাজ্ঞা অন্যদিকে চোরা শিকার কিভাবে নষ্ট করছে পরিবেশ তার বিবরন দেয়া হয়েছে। আর অপরিকল্পিত বসতি স্থাপনের জন্য খাদ্যাভাবে বন্যপ্রানী কিভাবে বসতিতে এসে ক্ষতি করছে এবং এক পর্যায়ে নিজেও মৃত্যবরন করছে তার কথা আছে এই বইটিতে। তথাকথিক পরিবেশবাদী দের চেয়ে অনেক বেশি যুক্তি সহকারে এই বিষয়গুলির সমাধান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এই বইগুলিতে।
৫. বনের স্মৃতি –আলী আকবর কোরেশী।
এটি ঠিক শিকার কাহিনী নয়। লেখক বনবিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। পাকিস্তান ফরেস্ট ইন্সটিটিউট থেকে ফরেষ্ট্রিতে গ্রাজুয়েট আলী আকবর কোরেশী ১৯৬০ সালে বনবিভাগে রেঞ্জার হিসেবে যোগ দেন। চট্টগ্রাম,মধুপুর গড়,সিলেট এবং সুন্দরবন এলাকায় তার দায়িত্ব পালনের সময় বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ঘটনÍ স্মৃতি নিয়ে লেখা এই বইটি বেশ আকর্ষনিয়। দায়িত্ব পালনের সময় করা ছোট ছোট শিকার এবং প্রানী ধরার কাহিনি রয়েছে বিভিন্ন অধ্যায়ে। শিকারী পচাব্দি গাজীর সাথে লেখকের একটি শিকার কাহিনিও এতে অন্তর্ভুক্ত আছে। পোষা হরিনের আক্রমনে লেখকের ছোট ভাইর আহত হওয়া ও পরে মৃত্যর করুন কাহিনী খুবই মর্মস্পর্শি । নিজের জিবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখা আলী আকবর কোরেশীর এই গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে সাহিত্য প্রকাশ।
 

বিজয়ি বাংলাদেশ। বিজয়ি ক্রিকেট।

ক্রিকেট ইজ এ গেইম অফ গ্লোরিয়াস আনসারটেইনিটি" অর্থাত "গেীরবময় অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেট"।
আজকের খেলায় যেনো সেই কথাই আবার প্রমানিত হলো। এরকম প্রতিদন্বিতাপুর্ন ম্যাচ খূব কমই হয়েছে। যখন ১৬৭ রানে অষ্টম উইকেট চলে গেলো অনেকেই খেলা সম্পর্কে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। আবার একজন মনে করিয়ে দিলেন ১৯৭৫ সালের বিশ্বকাপে ওয়েষ্ট ইন্ডিজ বনাম পাকিস্তানের খেলার কথা যেটা ওয়েস্ট ইন্ডিজ শেষ উইকেটএ ৫৪ রান করে জিতেছিল। আর তার পর থেকেই শুরু হলো বাংলাদেশের ফিরে আসা। অভিনন্দন সফিউল ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে। বিশেষ করে সাকিব যখন আউট হয়েছিল তখন অনেকেই আশা ছেড়ে দিয়ে ছিলেন। তথাপি আমাদের দুই টেল এন্ডার দেখালেন চেষ্টা করলেই বিজয় অর্জিত হয়। সেই সঙ্গে ইমরুল ও তামিমকেও অভিনন্দন। এই বিজয়ের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন তারাই। সাকিব ও মুশফিক এর আউট দুটির ক্ষেত্রে বোলার এর কৃতিত্ব বেশ।ইমরুল কায়েস এর রানআউটটি ছাড়া বড় বেশি কোন ভূল শট না খেলেনি বাংলাদেশ।
আর আজকে প্রথমেই ইংল্যান্ড এর প্রথম ব্যাটসম্যান প্রায়োর যেভাবে আউট হলেন তাতেই বোঝা যায় প্রথম থেকেই তেমন বিজয়ের জন্য আত্মপ্রত্যয়ি ছিল বাংলাদেশ। আপিল করার পরও স্ট্যাম্প তুলে নেয়ার কথা কম উইকেট রক্ষকেরই মনে থাকে। উইকেট হারানর পরেও সাহস করে শেষ দুই ব্যাটসম্যান যেভাবে খেললেন তাই বিজয়ের পথে নিয়ে গেছে বাংলাদেশের পতাকা।

চমৎকার এই ম্যাচটি বিজয়ের জন্য অভিনন্দন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে। অভিনন্দন ইংল্যান্ডকেও একটি উপভোগ্য ম্যাচ উপহার দেয়ার জন্য।
চট্টগ্রাম সবসময়ই বাংলাদেশের জন্য লাকি গ্রাউন্ড বলে বিবেচিত। বাংলাদেশের বিশ্বকাপে আরো ভাল করুক আসুন এখন আমরা সবাই এই দোয়া করি।

সবকিছুর পরে বিজয়ি ক্রিকেট।

বিঃদ্রঃ কারো হাতে সময় থাকলে বিভিন্ন টেলিভিশনের বিশেষজ্ঞ ( বিশেষভাবে অজ্ঞ)গন আজ আঁতেলিয় ইংরেজিতে কি মন্তব্য করেন তার সংক্ষিপ্ত বিবরন দিলে ভাল হয়।

একজন নাজমুদ্দিন আরবাকান।একটি ফিনিক্স।

নাজমুদ্দিন আরবাকান এর ইন্তেকালের সাথে সাথে তুরুস্কের এবং ইসলামের ইতিহাসের এক যুগের অবসান হলো। যে যুগে ইসলাম ধ্বংস ও বিকৃতির অবস্থা থেকে পুনরায় বিজয়ির আসনে অভিষিক্ত হয়েছে।
নাজমুদ্দিন আরবাকানের জন্ম ১৯২৬ সালে। এর দুবছর আগেই তুরুস্ককে আধুনিক রাষ্ট্রে পরিনিত করার উদ্দেশ্যে কামাল আতাতুর্ক অবলুপ্ত করেছেন খলিফা ও সুলতানের পদ এবং দেশকে করেছেন ধর্মহিন। কৃষ্ন সাগরের তিরে সিনোপ শহরে জন্ম নেন আরবাকান। পিতা মুহাম্মদ সাবরী ছিলেন একজন বিচারক। দরিদ্র না হলেও সাধারত তবে অভিজাত বংশের সন্তান তিনি। ইস্তাম্বুলের ভাল স্কুলে লেখাপড়া করার সুযোগ পান তিনি। ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং এ গ্র্যাজুয়েট হন তিনি এরপর। এখানে তার ফলাফল ছিল জিপিএ ৪.০০ এর মধ্যে ৪.০০। এর পর জার্মানির রাইনল্যান্ড এর আর ডাব্লিউ টি এইচ, আচেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। প্রথমে ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। আরবাকান তার শিক্ষা জীবন অতিবাহিত করেন এমন এক সময় যখন কামাল আতাতুর্ক ধর্মনিরপেক্ষতার ও জাতিয়তাবাদের নামে তুরুস্ককে ধর্মহিন করার সমস্ত ব্যবস্থা নিয়েছিলেন যার মধ্যে তুর্কি ভাষায় আযান দেয়া ও ছিল। আর তার এই কাজগুলির প্রধান লক্ষ ছিল তৎকালিন ছাত্র ও যুবক শ্রেনী। এর মাঝে শিক্ষা লাভ করেও আরবাকান হয়ে উঠেন অনন্য। ১৯৬৫ সালে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন আরবাকান। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত থাকার সময় তিনি কয়েকটি গবেষনা ও ডিজাইন এর কাজ করেন যার মধ্যে জার্মান ট্যাংক লেপার্ড ১ অন্যতম। নাজমুদ্দিন আরবাকান এই ট্যাংক ডিজাইন প্রকল্পের প্রধান ছিলেন এবং এই ট্যাংক এবং এর উপর ভিত্তি করে তৈরি ট্যাংক লেপার্ড ২ এখনও জার্মানি, তুরুস্ক সহ ইউরোপিয় দেশগুলির সেনা বাহিনীতে ব্যবহৃত প্রধান ট্যাংক। ১৯৬৯ সালে আরবাকান বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন এবং এবং একই বছর তুরুস্কের ঐতিহাসিক নগরী কুনিয়া থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এসময় তিনি প্রকাশ করেন একটি ম্যানিফেষ্টো, ”মিল্লি গুরুস” বা জাতিয় দৃষ্টি নামে। এই নামের সংগঠন ও গড়ে তোলেন তিনি যা পরবর্তিতে রাজনৈতিক দলে পরিনিত হয়। ১৯৭২ সালে ”মিল্লি সালামত” বা ”ন্যাশনাল স্যালভেশন পার্টি” নামে আরেকটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন আরবাকান। তুরুস্কের আইনগত কারনে সরাসরি ইসলামের কথা বলা সম্ভব না হলেও তার দল সবসময় ইসলামের পুনরজ্জিবন এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে ধর্ম বিরোধিতার বিপক্ষে বলে আসছিল। ”মিল্লি সালামত" পার্টি ১৯৭৩ সালের তুরুস্কের জাতিয় নির্বাচনে ১২ শতাংশেরও অধিক ভোট পায়। ধর্মহিনতায় আচ্ছন্ন্ তুরুস্কে যা ছিল একটি অভাবনিয় ব্যাপার। এসময় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী রিপাবলিকান পার্টির সাথে কোয়ালিশন সরকার এ যোগ দেয় এই দল। এসময় তুরুস্ক সাইপ্রাস সংক্রান্ত একটি সমস্যার মোকাবেলা সফলভাবে করতে সমর্থ হয়। ১৯৮০ সালে তুরুস্কে আবার সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে এবং আরবাকান এবং তার দল কে তুরুস্কে রাজনিতীতে নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। ১৯৮৭ সালে আরবাকানের নেতৃত্বে গঠিত হয় রিফাহ পার্টি বা ওয়েলফেয়ার পার্টি ১৯৯০ সালের নির্বাচনে এই দল প্রচুর ভোট লাভ করে এবং প্রধান বিরোধি দল হয়। ১৯৯৫ সালে প্রায় ২২ শতাশং ভোট লাভ করে ওয়েলফেয়ার পার্টি এবং একক সংখ্যাগরিষ্ঠ না হলেও পার্লামেন্টে সর্ববৃহত রাজনৈতিক দলের মর্যাদা পায়। ১৯৯৬ সালে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয় এবং এর প্রধান মন্ত্রি হন নাজমু্িদ্দন আরবাকান। তিনিই আধূনিক তুরুস্কের প্রথম প্রধানমন্ত্রি যিনি কখনও প্রকাশ্যে ইসলাম বিরোধিতা করেননি । প্রধান মন্ত্রি হিেসবে তিনি আরব রাষ্ট্র সমূহ এবং ফিলিস্তিনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করেন। তার উদ্যোগে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালেয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া,ইরান,নাইজেরিয়া,মিসর ও তুরুস্ককে নিয়ে একটি জোট গঠিত হয় ডি-৮ বা ডেভেলপিং ৮ নামে। এই জোট প্রতিষ্ঠার পেছনে তার মুল উদ্দেশ্য ছিল যে কয়েকটি মুসলিম দেশ শিল্পায়ন,প্রযুক্তি,দক্ষ জনশক্তি এবং গনতন্ত্রের দিক দিয়ে এগিয়ে তাদের পরস্পরের সহযোগিতা, বিশেষত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ও বানিজ্য বৃদ্ধি করা। উল্লেখ্য এই সময় তুরুস্কের প্রেসিডেন্ট সুলায়মান ডেমিরেল বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। কিন্তু তার এই উদ্যোগ তুরুস্কের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী সেনাবাহিনী ও তথাকথিত সাংবিধানিক আদালতের পছন্দ হয়নি। সামরিক বাহিনী প্রধান উদ্যোগ নিয়ে সেসময় প্রধান দুটি বিরোধি দলের মধ্যে একটি সমঝোতা করে এবং মাসউদ ইলমাজ তুরুস্কের প্রধান মন্ত্রি হন। প্রধানমন্ত্রির পদ থেকে অবসর নেয়ার পর তার দল ওয়েলফেয়ার পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয় এবং তাকেও তুরুস্কের রাজনিতিতে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর ওয়েলফেয়ার পার্টির সদস্যরা গঠন করেন "ভার্চু পার্টি" নামে আরেকটি রাজনৈতিক দল। ভার্চু পার্টি পরবর্তি সংসদ নির্বাচনে বেশ ভাল ফল করে। এই পার্টি থেকেই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মার্ভ কাভাকচি যিনি মাথায় কাপর দিয়ে তরুস্কের সংসদে প্রবেশের অপরাধে সংসদ সদস্য পদ হারান এবং পরে দেশ থেকে নির্বাসিত হতে বাধ্য হন। ২০০১ সালে তরুস্কের সাংবিধানিক আদালত ভার্চূ পার্টিকেও নিষিদ্ধ করে। এরপর ভার্চু পার্টির সদস্য রা দুই ভাগ হয়ে যান। ভার্চু পার্টিে নেতৃত্বে থাকা সদস্যরা গঠন করেন ফেলিসিটি পার্টি এবং অপেক্ষাকৃত তরুন দল গঠন করে জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি। প্রত্যক্ষ রাজনিতিতে নিষিদ্ধ হলেও ভার্চু পার্টি ও ফেলিসিটি পার্টির শুরু থেকেই এই দলের তাত্বিক গুরুর স্থানে ছিলেন তিনি। তার উপর নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হলে তিনি ফেলিসিটি পার্টিতে যোগ দেন। কিন্তু একসময় তার অনুসারি তরুনদের গঠিত জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি নির্বাচনে এগিয়ে যায়। ২০০৭ সালের নির্বাচনে এই পার্টি ৪৬ শতাংশ ভোট পায় যা তরুস্কের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। নাজমুদ্দিন আরবাকান এই দলের সাথে জড়িত না থাকলেও এই দলের নেতৃবৃন্দ তার হাতেই গড়া এবং তারা তাকে শ্রদ্ধা করেন। তুরুস্কে বর্তমানে যে সংস্কার হচ্ছে এবং সামরিক বাহিনীর আধিপত্য কমিয়ে প্রকৃত গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও ইসলাম পুনপৃতিষ্ঠিত হচ্ছে সে জন্য আরবাকানের অবদান অপরিসীম। নাজমুদ্দিন আরবাকান সম্পুর্ন রুপে ইসলামি বিরোধি পরিবেশে শিক্ষা লাভ করেও স্রোতের বিপরিতে নিজের ঐতিহ্য এবং ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন হন। আরবাকান তার রাজনিতি কেবলমাত্র কথায় আর রাজনিতির ময়দানে সীমাবদ্ধ না রেখে কফি হাউজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছেন। অর্থনৈতিক স্বাধিনতা এবং প্রযুক্তির উন্মেষযে প্রকৃত স্বাধিনাতার জন্য অত্যন্ত জরুরি তা প্রকেীশলি আরবাকান ভালভাবে জানতেন। ডি-৮ গঠনের মধ্যে দিয়ে তার মুসলিম বিশ্বের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ইচ্ছা বোঝা যায়।

সম্পুর্ন বৈরি পরিবেশে থেকেও কোন রুপ সংঘাতে না গিয়েও কিভাবে ধৈর্য ও কেীশল অবলম্বন করে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় তা আরবকান আমাদের দেখিয়ে গেলেন। গ্রীক উপকথার ফিনিক্স পাখির মত যতবার তাকে ধ্বংশ করা হয়েছে ছাই থেকে পুনরায় তিনি ফিরে এসেছেন আর বিজয়ি হয়েছেন।

আমরা সবাই তার রুহ এর মাগফিরাত কামনা করছি।

বিঃদ্রঃ তুরুস্কের নির্বাচন ব্যবস্থা আমাদের থেকে ভিন্ন। সেখানা ভোটাররা প্রার্থিকে নয় বরং রাজনৈতিক দল সমূহকে ভোট দেয়। প্রাপ্ত ভোটের হার অনুসারে দলগুলি পার্লামেন্টে আসন লাভ করে।

মিসরী মেয়ের হাসি।

মিস্টি ধারাল মিছরির ছুরি মিসরী মেয়ের হাসি
হাঁসা পাথরের কুচিসম দাঁত,সব যেন আজ বাসি।

মিসরের স্বাধিনতা আন্দোলনের প্রধান নেতা সাদ জগলুল পাশার ইন্তেকালে জাতিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার অনুভুতিকে প্রকাশ করে ছিলেন এইভাবেই। আজকে একটু অন্যভাবে হলেও এই চরনদুটিই মনে পড়ছে। সেদিন জাতিয় কবি মিসরের দুঃখে এই চরনদুটি লিখেছিলেন। আজকে মিসরের আনন্দেই যেন মিসরী মেয়ের হাসি টা বাসি মনে হচ্ছে।
মিসরের ইতিহাস আর পৃথিবীর ইতিহাস যেন সমসাময়িক। পৃথিবীর প্রাচিনতম সভ্যতার নির্দশনগুলি পাওয়া গেছে মিসরেই। পৃথিবীর সকল ধর্ম গ্রন্থেই মিসরের নাম এসেছে বিভিন্ন প্রসঙ্গে। অসংখ্য নবী-রাসূল এর জন্ম ও কর্ম ক্ষেত্র মিসর। আবার ফেরাউনের মত খোদাদ্রোহিদের দেশও মিশর।
৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে আমর ইবনুল আস (রাঃ) এর নেতৃত্বে মাত্র চার হাজার মুজাহিদ বিশাল রোমক বাহিনীকে পরাজিত করে মিসরে ইসলামের দাওয়াত পেীছানোর পর থেকে এখনও পর্যন্ত মিসর মুসলিম সভ্যতার অন্যতম নির্দশন হিসেবে বিবেচিত। গাজী সালাউদ্দিন এর স্মৃতি বিজরিত মিসর থেকে জন্ম নিয়েছেন অসংখ মুসলিম বীর,আলেম,বিজ্ঞানী।
১৮০০ সালে মিসরের ক্ষমতায় আসেন আলবেনিয় বংশদ্ভুত মুহাম্মদ আলি। নামে মাত্র তুর্কি খলিফার আনুগত্য প্রকাশ করে স্বাধিন ভাবে মিসরে নতুন সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। তিনি একজন যোগ্য শাসক হলেও মুসলিম সভ্যতার পতনের সময় তার উত্তর আধিকারীরাও ছিলেন অযোগ্য। ১৮৮২ সাল থেকেই মিসর একরকম বৃটিশ ও ফরাসি দ্বৈত নিয়ন্ত্রনে চলে যায়। এর মধ্যে ১৮৬৯ সালে চালু হয় সুয়েজ খাল। যা এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে নেী দুরত্ব কমিয়ে দেয় অনেকখানি যা ইউরোপিয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলিকে তাদের এশিয়ার উপনিবেশগুলি থেকে সম্পদ লুট ও নিয়ন্ত্রন করা সহজ করে তোলে। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মিসর সরাসরি বৃটিশ নিয়ন্ত্রনে চলে যায়। তবে নামমাত্র সুলতানের পদ বজায় থাকে। যুদ্ধ শেষে মিসরের ষ্বাধিনতা আন্দোলন তিব্র হয়ে উঠে সাদ জগলুল পাশার নেতৃত্বে। এ অবস্থায় ১৯২২ সালে বৃটেন মিশরকে সল্প স্বাধিনতা দেয়। ১৯২৪ সালে সাদ জগুলল পাশা সল্প সময়ের জন্য প্রধান মন্ত্রি হলে মিসরের পুর্ন স্বাধিনতার চেষ্টা শুরু করলে তাকে পদচুত্য করা হয়। মিসর ১৯৫২ সাল পর্যন্ত বৃটিশ নিয়ন্ত্রনে সামান্য স্বাধিনতা বজায় রাখে। এর মধ্যে ১৯৩৯ সালে শুরু হয় দ্বিতিয় মহাযুদ্ধ। মিসর দ্বিতিয় মহাযুদ্ধের কয়েকটি ভয়ংকর যুদ্ধের ক্ষেত্র। যুদ্ধের প্রয়োজনে বৃটিম সরকার মিসরের একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু এই সশন্ত্র বাহিনীর সদস্যরা অনেক্ই হয়ে উঠেন জাতিয়তাবোধে উদ্ভুদ্ধ। এর আগে ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইখওয়ান আল মুসলিমিন বা মুসলিম ব্রাদারহূড। ইসলামি আদর্শে জাতিয়তাবোধ ও স্বাধিনতার সংগ্রামে উদ্ভুদ্ধ তরুনরা হাসান আল বান্নার নেতৃত্বে সংগঠিত হয় ইখওয়ান আল মুসলিমিনে। এদিকে সেনাবাহিনীতে কর্মরত একদল অফিসার যারা নিজেদেরকে ফ্রি অফিসার্স নামে অভিহিত করতেন তারা মিসরের রাজতন্ত্র উচ্ছেদ এবং পুর্ন স্বাধিনতার জন্য সংগ্রামের প্রস্তুতি নেন। এই দলের ম্যেধ ছিল মিশ্র মানসিকতার মানুষ। কেউ কেউ ছিলেন ইসলামি আদর্শে উদ্ভদ্ধ কেউবা জাতিয়তাবাদি আধুনিক কেউ আবার স্রেফ সুযোগ সন্ধানি। ১৯৫৩ সালে ফ্রি অফিসার রা জেনারেল মুহাম্মদ নগিবের নেতৃত্বে মিসরের পুর্ন স্বাধিনতা ঘোষনা করে এবং মিসরের শেষ রাজা ফারুককে নির্বাসন দেয়। নগিব সাময়িকভাবে একটি সরকার গঠন করেন। ইখওয়ানুল মুসলিমিন সহ অন্যান্য স্বাধিনতাকামী রাজনৈতিক শক্তি সমর্থন দেয় তাকে। কিন্তু সুযোগ সন্ধানি জামাল আবদুল নাসের ১৯৫৪ সালে নগিব কে ক্ষমতাচুত্য ও গৃহবন্দি করেন। এর পর জামাল নাসের প্রতিষ্ঠা করেন স্বৈরতান্ত্রিক এক শাসন। ইখওয়ান আল মুসলিমিন সহ অন্যান্য বিরোধি রাজণৈতিক শক্তিকে উচ্ছেদ ও র্নিমূলে কঠোর ব্যবস্থা নেন। অন্যদিকে মিসর কে গড়ে তুলতে শুরু করেন পাশ্চাত্য স্টাইলে। তার শাসনামলে মিসর হয়ে উঠে প্রাচ্যের সভ্যতা থেকে পাশ্চাত্য অপসংস্কৃতির লিলাভুমি হিসেবে। জামাল নাসের অত্যাচারি এবং স্বৈর শাষক হলেও ছিলেন জাতিয়তাবাদী। ১৯৫৬সালে তিনি সুয়েজখাল জাতিয়করন করেন।১৯৫৬ ও ১৯৬৭ সালে দুটি যুদ্ধে ইসরাইল ও বৃটেন ও ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধ করেন। ১৯৭০ সালে জামাল নাসের এর মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন তার দির্ঘদিনের সহযোগি আনওয়ার সাদাত। ১৯৭৩ সালে আবার ইসরাইল এর সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পরে মিসর। সিনাই উপদ্বিপ উদ্ধার করতে সমর্থ হওয়ায় তার জনপ্রিয়তাও কিছুটা বৃদ্ধি পায়। আনওয়ার সাদাত আভ্যন্তরিন বিষয়ে কিছূটা নমনিয় ভাব প্রদর্শন করেন। ইখওয়ানঅাল মুসলিমিনের বিরুদ্ধে চলতে থাকা অত্যাচার অনেকটা হ্রাস পায়। কিন্তু সাদাত ইসরাইল কে স্বিকৃতি দিলে এবং ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি সাক্ষরের কারনে আবার জনগনের বিরাগ ভাজন হন্। ১৯৮১ সালে সাদাত এর আকস্মিক মৃত্যু ভাগ্য খুলে দেয় হোসনি মুবারকএর। বিমানবাহিনীর অফিসার হোসনি মুবারক তার পথম জীবন পুরোটাই ছিলেন এক জন ক্যারিয়ার সামরিক ব্যাক্তি। রাজনৈতিক বিষয়ে বিশেষ মনযোগ তার ছিলনা। টেকনিক্যাল পার্সন হিসিবেই তিনি প্রথমে প্রতিরক্ষা মন্ত্রি নিয়োজিত হন এবং পরে সাদাত স্রেফ তার সহকারী হিসেবে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নিয়োগ দেন তাকে। সাদাত এর আকস্মিক মৃত্যু তাকে মিসরের নতুন ফেরাউন হিসেবে আবির্ভাবের সুযোগ করে দেয়। ১৯৮১ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত মিসরে জারি আছে জরুরি অবস্থা। জনগনের মেীলিক অধিকার রয়েছে স্থগিত। হুসনি মুবারক কয়েকবার নামমাত্র নির্বাচন দেন যে সকল নির্বাচনে তিনি ৯০ শতাংশ ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি ও মিসরের অর্থনৈতিক অবষ্থা তার শাসন এর বিরুদ্ধে জনগনকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করে। হুসনি মুবারক কয়েকবার পার্লামেন্ট নির্বাচন দেন কিন্তু প্রবল বাধা এবং অত্যাচার সত্বেয় এই নির্বাচনগুলিতে তার বিরোধি দলগুলি বিশেষ করে ইখওয়ান আল মুসলিমিন অনেক আসন লাভ করে। তবে ১৯৫৪ সাল থেকেই ইখওয়ান আল মুসলিমিন রাজণৈতিক দল হিসেবে মিসরে নিষিদ্ধ। এর প্রর্থিরা সতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে অংশ গ্রহন করেন। এদিকে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে এক সময় সোভিয়েট ইউনিয়নের পরম বন্ধু হুসনি মুবারক মার্কিন ছাতার তলে আশ্রয় গ্রহন করে নিজের ক্ষমতা বজায় রাখার প্রয়াস পান। ইতঃমধ্যে মিসরের প্রতিবেশি তিউনিসিয়ার জনগন বিপ্লবরে মাধ্যমে উচ্ছেদ করে স্বৈরশাসক বেন আলি কে। ২০১১ সালের ২৫ শে জানুয়ারি এই সাফল্যে উদ্ভুদ্ধ মিসরিয় তরুন সমাজ নেমে আসে রাজপথে ষাট বছর ধরে চলতে থাকা স্বৈর শাসন উচ্ছেদ করে জনগনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। জনগনের মানসিকতা দেখেই সম্ভবত হুসনি মুবারকের প্রধান খুটি সেনাবাহিনী এই বিপ্লব প্রতিরোধ করতে শক্তি প্রয়োগে সম্মত হয়নি। শেষ পর্যন্ত নানা টালবাহানা করে হুসনি মুবারক ও তার সরকার ১১ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করলেন সশস্ত্র বাহিনীর সুপ্রীম কমান্ড কাউন্সিল এর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। জনগন হুসনি মুবারককে হঠানর সাফল্যে আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়েছে মিসরের আনাচে কানাচে। আর পৃথিবীর সকল মুক্তিকামী মানুষও সেই আনন্দের অংশিদার হয়ে আজকে অভিনন্দন জানাচ্ছে মিসরের বিপ্লবি জনতা কে।

মিসরের ভবিষ্যত এখনও অস্পষ্ট। ক্ষমতা গ্রহনকারী সশস্ত্রবাহিনীর পরবর্তি পদক্ষেপ কি হবে তা এখনও অজানা। নতুন কোন স্বৈরশাসক আবার ক্ষমতায় চেপে বসবে না জনগনের সরকার কায়েম হবে সে প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে। তবুও আজকের দিনটি অবশ্যই জনগনের বিজয়ের দিন। সশস্ত্র বাহিনী নিশ্চয় জনগনের মানসিকতা বুঝতে পারছে। নতুন কোন স্বৈরশাসক যদিওবা চেপে বসতে চেষ্টা করে তার মেয়াদ নাসের,সাদাত বা হুসনি মুবারক এর মত দির্ঘ ও কুসুমাস্তির্ন হবেনা সেটা নিশ্চিত। যে জনতা একবার জেগে উঠেছে তাকে ঘুম পাড়ান সহজ নয়।

উপদেষ্টার উপদেশ বা অপদেশ

হানিফ সংকেতের একটি কেীতুক নকশায় দেখেছিলাম চাকরি প্রার্থির উল্টাপাল্টা জবাব আর তোষামোদে বিরক্ত ইন্টারভিউগ্রহিতা শেষ পর্যয়ে চাকরি প্রার্থিকে তার উপদেষ্টার চাকরি দেন। চাকরি প্রার্থি সাথে সাথে তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেন। এর পর বস তার উপদেষ্টার কাছে প্রথম যে উপদেশ চান তা হচ্ছে," কিভাবে গলাধাক্কা দিয়ে আপনাকে আমি এখান থেকে বের করে দিব"।

উপদেস্টা বা অ্যাডভাইজার পদটি ব্যবসায় ও রাজনৈতিক উভয় ব্যাপারে বহুল প্রচলিত। সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই উপদেষ্টা নিয়োজিত হন। এরা সাধারনত কোন নিয়মিত বেতনভাতা পাননা। বৈঠক বা কোন নিদৃষ্ট বিষয়ে ফাইলে পরামর্শ বা উপদেশ দেন এবং সেই অনুযায়ি ফি পেয়ে থাকেন। তারা সাধারনত মন্ত্রনালয়,বিভাগ কিংবা কোন প্রকল্প অনুসারে নিয়োজিত হন। এর বাইরেও সরকার উচ্চ পর্যায়ে কিছু উপদেষ্টা নিয়োগ করে থাকেন যারা সাধারনত মন্ত্রি সভার সদস্যের পদমর্যাদা ভোগ করে থাকেন কিন্তু মন্ত্রিদের মত সাংবিধানিক অধিকার সমূহ তাদের জন্য প্রযোজ্য হয়না। এক সয় জ্বালানী উপদেষ্টার দ্বায়িত্ব পালনকারী বর্তমানে বন্দি আমারদেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের এক লেখায় একবার পড়েছিলাম উপদেষ্টা হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন কতটা কষ্টের। কারন সাংবিধানিক ক্ষমতা নাথাকায় কোন ফাইলে তারা সাইন করতে পারেননা কিন্তু কোন মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বে থাকলে সেই মন্ত্রনালয় পরিচালনায় তাকে অংশ গ্রহন করতে হয় মন্ত্রি বা প্রতিমন্ত্রিদের মতই। সুতারাং সরকারের মন্ত্রি/প্রতিমন্ত্রি পদমর্যাদায় কর্মরত উপদেষ্টাদের দায়িত্ব কম নয়।
এহেন উপদেষ্টা যদি বলে বসেন শেয়ার বাজারের বিনিয়োগকারীরা হচ্ছেন দেশের শত্রু তবে তার যোগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহ হওয়া অতি স্বাভাবিক। যদিও তার নামের আগে যুক্ত আছে ডক্টর শব্দটি।
বানিজ্য বিভাগে এস,এস,সি পরিক্ষার্থি রাও জানে শেয়ারবাজার কি। শেয়ার বাজার থেকে কিভাবে বিভিন্ন কোম্পানি পুঁজি সংগ্রহ করে উৎপাদন ও ব্যবসায় খাটায়। হ্যা এটা সত্যি যে সেকেন্ডারি বাজারে শেয়ার হাত বদলের মাধ্যমে যে অর্থের লেনদেন হয় তা সরাসরি উৎপাদনে নিয়োজিত হয়না। কিন্তু এই লেনদেন কোম্পানি টির পরিচালনাকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রন করে। যদিও আমাদের দেশে তা বিভিনন্ন কারনে পুরোপুরি সঠিকভাবে হয়না। তবুও এই বিনিয়োগ অবশ্যই জাতিয় অর্থনিতিতে প্রভাব ফেলে। কোম্পানির শেয়ারের মুল্য দিয়ে নির্ধারিত হয় কোম্পানিটির মুল্য। যা তার লাভ ক্ষতি নিরুপনের জ্যন অতি প্রয়োজনিয়। শেয়ার মার্কেট হচ্ছে যে কোন দেশের জাতিয় পুঁজি গড়ে তোলার অন্যতম প্রধান মাধ্যম। একারনে ইংরেজিতে শেয়ারবাজারের আরেক নাম ক্যাপিটাল মার্কেট। একারনে প্রতিদিনই বিশ্বের প্রধান সংবাদ মাধ্যম গুলির সংবাদের বড় অংশ জুড়েই থাকে শেয়ারবাজারের খবর। নিয়মিত পত্রিকা পড়েন এমন সকল ব্যাক্তিই জানেন ১৯২৯ সালের দি গ্রেট ডিপ্রেশনের সূচনা হয়েছিল শেয়ার বাজারের পতন থেকেই এবং ২০০৭ সালের বিশ্ব ব্যাপি মন্দার শুরু ও স্টক মার্কেটের পতন থেকে। অর্থাত শেয়ার বাজারের অবস্থা অব্শ্যই অর্থ্নিতির অন্যান্য সূচকের সাথে সম্পর্কিত এবং এর কোন সমস্যা পুরো অর্থনিতিকে প্রভাবিত করে।
এখন সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট কেউ যদি বলে বসেন শেয়ার বাজারের দর পতন নিয়ে সরকারের কোন মাথাব্যাথা নাই তাহলে যে কোন সচেতন ব্যাক্তির মনেই প্রশ্ন জাগতে বাধ্য যে এই ব্ক্তব্য প্রদানকারী আদেী অর্থ্নিতির সম্পর্কে জানেন কিনা। শেয়ার বাজার রেগুলেশন ও তত্বাবধানের দ্বয়িত্ব সরকারের। এখন শেয়ার বাজারের টাকা যাতে সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় তা দেখার দায়িত্ব ও সরকারের। সরকার যদি সময়মত কোন কারনে সময়মত তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তা হলে সে দায়িত্ব সরকারের। বিশেষজ্ঞ গনের প্রায় ছমাস আগে দেয়া সতর্কবানি তখন আমলে নিলে আর যাই হোক এরকম আকাশপাতাল তফাত হতোনা। অন্য দিকে রাতারাতি সবকিছুকেই নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করতে গিয়ে পুরো বিষয়টি লেজে গোবরে করে দিয়েছে সরকার। এই অবস্থায় সরকারের কোন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যবক্তিযদি ঢালাও ভাবে বিনিয়োগকারীদের দেশের শত্রু বলে অভিহিত করেন তা হলে সেই ইন্টারভিউ গ্রহনকারীর মত বলতে ইচ্ছে আপনি বরং সরকারকে সেই উপদেশ দিন কিভাবে আপনার মত অযোগ্য উপদেষ্টার হাত থেকে সরকার,দেশ ও জনগন রক্ষা পাবে।

২০,জানুয়ারি ২০১১, শেয়ার বাজারে ব্যাপক দরপতনের পর চট্টগ্রামে বিনিয়োগকারীদের প্রতিবাদ বিক্ষোভের ভিডিও দেখুন এই লিংকে।
[http://www.youtube.com/watch?v=CwglQEthLAY]

ব্ল্যাক সানডে থেকে ব্ল্যাকহোল মানডে।

পশ্চিম ইউরোপিয় সংস্কৃতিতে মাসের তের তারিখ শুক্রবার পড়াকে খুব অশুভ বলে গন্য করা হয়। এই রকম দিন কে বলা হয় ব্ল্যাক ফ্রাইডে। এর উৎস সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ আছে। যেমন কেউ বলেন এই দিনেই যিশুখ্রিষ্টকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল তাই এই দিন অশুভ আবার কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে এই দিন টেম্পলার নাইট দের বিরুদ্ধে সারা ইউরোপ ব্যাপি অভিযান পরিচালিত হয়েছিল। যদিও এই দিনটি সম্পর্কে অশুভ মনে করার বিশ্বাস খৃষ্টপুর্ব সময় থেকে চলে আসছে বলে বেশিরভাগ পন্ডিত ব্যাক্তিই একমত।
অর্থনিতির ক্ষেত্রে ১৯২৯ সালের অক্টোবর মাসে নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেন্জ এর বিশাল দর পতন কে বলা হয় ব্ল্যাক ফ্রাইডে। এই দরপতন এর দিন থেকেই শুরু হয় দি গ্রেট ডিপ্রেশন বা বিশ্বব্যাপি অর্থনৈতিক মন্দা যা স্থায়ি হয় দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত। ২৯ শে অক্টোবর ১৯২৯ সাল ছিল প্রকৃত পক্ষে বৃহস্পতি বার। তবে তখন এত দ্রুত তথ্য পরিবহনের ব্যবস্থা ছিলনা বিধায় এই বিশাল দর পতনের খবর সবখানে পেীছতে সময় লেগে যায় যার কারনে এবং এই দর পতনের ভয়াবহতার জন্য এদিনটি ব্ল্যাক ফ্রাইডে বলে পরিচিত হয়ে উঠে।

গতকাল ৯ই জানুয়ারি,২০১১ রবিবার কে দৈনিক নয়াদিগন্ত শিরোনাম করেছে পুজিবাজারের ব্ল্যাক সানডে হিসেবে। কারন সারা দিনের ট্রেড শেষে মুল্য সুচক বা ইনডেক্স কমেছে দেশের উভয় স্টক এক্সচেন্জ এ ছয় শত পয়েন্ট এরও বেশি। যা শতকরা হিসেবে যথাক্রমে ৭.৭৫ ও ৬.৩৪ শতাংশ ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেন্জে এ। গতকাল বাজার প্রথম একঘন্টায় পড়ে প্রায় ২০০ পয়েন্ট। মাঝখানে সাময়িকভাবে উর্ধগামি হলেও দিনের শেষে এই মুল্য কমে যায়। আর আজকে ১০ই জানুয়ারি,২০১১ সোমবার লেনদেন শুরুর প্রথম একঘন্টার মধ্যেই ঢাকা স্টক এক্সচেন্জ এর সূচক কমে যায় ছয়শ পয়েন্ট এরও বেশি। এ অবস্থায় উভয় স্টক এক্সচেন্জ এর লেনদেন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।
আমাদের শেয়ার বাজারের পরিস্থিতিতে এই দরপতন অপ্রত্যাশিত না হলেও এতটা দরপতন খুবই অস্বাভাবিক। শেয়ার বাজারের বিশেষজ্ঞগন প্রায় ছয়মাস ধরে বলে আসছিলেন এই দর পতনের আশংকার কথা বলে আসছিলেন। বিভিন্ন কারনে দেশে শিল্প বিনিয়োগে স্থুবিরতা এবং ব্যবসায় মন্দা মানুষকে নিয়ে আসছিল শেয়ার বাজারে। এই কারনে আমাদের শেয়ার বাজারগুলিতে বাজার মূলধন বেড়ে যায় অস্বাভাবিকভাবে অন্যদিকে ভাল শেয়ারের সরবরাহ ছিল কম। বিনিয়োগে স্থবিরতার জন্য ব্যাংকগুলি তাদের আমানতের বিশাল অংশ বিনিয়োগ করে শেয়ার বাজারে। কনভেনশনাল ব্যাংকগুলির জন্য আমানত অর্থ অব্যবহৃত অবস্থায় ফেলে রাখা অসম্ভব। কারন তারা আমানতের উপর নিদৃষ্ট হারে সুদ দিতে বাধ্য। তাই তারা বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে শেয়ার বাজারকে বেছেনিয়েছিল। অন্য দিকে ব্যাংক থেকে এবং নিজস্ব উদ্যোগে বিনিয়োগকারীরা শিল্প স্থাপন করতে গিয়ে বিদ্যুত এবং গ্যাস সুবিধা না পেয়ে এবং সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির শিকার হয়ে শিল্প স্থাপন করতে ব্যার্থ হয়ে তাদের মূলধনকে শেয়ার বাজারে নিয়ে আসেন। অন্যদিকে বুকবিল্ডিং বা ডিরেক্ট লিস্টিং পদ্ধতিতে কিছু কোম্পানি অতি উচ্চ মুল্যে তাদের শেয়ার বিক্রি করে টাকা নিয়ে যায় বাজারের বাইরে কিন্তু এই কোম্পানিগুলি শেয়ার বাজারে রয়ে যায় অতি উচ্চ মুল্যায়িত অবস্থায়। শেয়ার বাজারের এই অবস্থার সাথে আবার যুক্ত হয়েছে তথাকথিত মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বা ইউনিপেটু জাতিয় কোম্পানি সমূহের বিস্তার। এই কোম্পানিগুলির অতি সল্প সময়ে(কোন ক্ষেত্রে তিনমাসের মধ্যে)টাকা দিগুন করার অফারের প্রেক্ষিতে অনেকেই এখন শেয়ার বাজারে নাএসে বিনিয়োগ করছেন এই কোম্পানি গুলিতে ফলে কমে যাচ্ছে বাজারের শেয়ার ক্রয়ের ক্ষমতা।
সব কিছু মিলিয়ে আমাদের শেয়ার বাজারে সৃষ্টি হয় একটি বুদবুদ এর যার বিস্ফোরন মাত্র দুদিনে পথে বসিয়ে দিয়েছে অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীতে।
গত কয়েকদিন থেকেই সূচক নিন্ম মুখি হলেও গতকালের মত বিশাল অংকের পতন এবং আজকের এক ঘন্টায় সমান পতন আমাদের স্টক মার্কেটের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আরোবিমুখ করে তুলছে।
গত কয়েকমাস ধরেই বাজার বিশেষজ্ঞরা এই পতন ঠেকানো এবং অতিমুল্যায়িত বাজারকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিতে এসইসি ও সরকারকে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু উভয় কর্তপক্ষই আমলাতান্ত্রিক গদাই লস্করি চালে নিচ্ছিলেন তাদের পদক্ষেপ। অন্য দিকে শেয়ার বাজারে ব্যাংক সমূহের বিনিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকএর হঠাৎ করে বেশি নিয়ন্ত্রন আরোপ এবং বিভিন্ন পদক্ষেপ আমাদের অস্থির শেয়ার বাজারকে আরো অস্থিতিশিল করে তোলে। রাতারাতি ব্যাংকগুলির বিনিয়োগ ঝুঁকি হ্রাসের চেষ্টা ঝুঁকিতে ফেলে দেয় লক্ষলক্ষ বিনিয়োগকারীদের। অথচ ব্যাংক সমূহের শেয়ার বাজারের অতিরিক্ত বিনিয়োগের বিষয়টি প্রায় দেড় বছর আগে থেকে আলোচিত হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক এতদিন কোন পদক্ষেপ নেয়নি।
সরকার ও এসইসির বিভিন্ন কার্যকলাপ ও সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদের বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে তারা লাঠি দিয়েই শেয়ার বাজারকে নিয়ন্ত্রনে আনতে উৎসাহি। অন্য দিকে এই দর পতনটিতেকস্বাভাবিক নয় বলেই সকল বাজার বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেছেন। গতকালের বিশাল পতনের পর তারা বলেছিলেন মুল্য যথেষ্ট সংশোধন হয়েছে এখন সাময়িকভাবে হলেও বাজার উর্ধগামী হবে। কিন্তু তাদের বক্তব্যকে অসাড় প্রমানিত করে মাত্র এক ঘন্টায় আজকে শেয়ার বাজারের এই পতন। শেয়ার বাজারে অতিমুল্যায়িত শেয়ার অবমুল্যায়নের মাধমে সূচক কমে যাওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে সকলেই অবহিত ছিলেন। কিন্তু সাধারন বিনিয়োগকারীরা উত্তেজিত হয়েছেন অতি অল্প সময়ে এই পতন দেখে। বিশেষজ্ঞরাও এটা আশা করেননি। তারা ধাপে ধাপে সূচক কমে যওয়ার কথা বলেছিলেন।
আজকে ট্রেড বন্ধ রেখে এসইসি যে সকল সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার খুববেশি কোন প্রভাব শেয়ার বাজারের ফেলবে বলে মনে হয় না। মানুষের মনে এখনও প্রচুর শংকা রয়েছে।

শেয়ার বাজারের বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এই বাজারের গতি প্রকৃতি কোন গানিতিক বা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষন দিয়ে বের করা সম্ভব নয়। এটি বর্তমানে ব্ল্যাকহোলের মত অবস্থায় চলে এসেছে।
যাতে কেবল কিছূ ঢকে আর বের হতে পারেনা। ব্ল্যাক হোল কোন বৈজ্ঞানিক তত্ব অনুযায়ি চলেনা। আমাদের শেয়ারবাজার ও যেন এখন সেই রকম হয়ে গেছে। আজকের দিনটি যেন আমাদের শেয়ার বাজারকে নিয়ে গেছে একটি ব্ল্যাকহোলে যেখানে কোন প্রতিষ্ঠিত সত্য ও গানিতিক ফর্মুলা কাজ করেনা। অনিশ্চয়তাই যেখানে সত্য।
আজকের দিনটিকে আমরা ব্ল্যাকহোল মানডে বলে অভিহিত করতে পারি।

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষন বিমান পিটি-৬।

অন্য একটি ব্লগে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক দুর্ঘটনা সম্পর্কে একটি চমৎকার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। সেটা যারা পড়েছেন তাদের বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষন বিমান পিটি-৬ সম্পর্কে কিছু জানার ইচ্ছা থাকতে পারে। তথ্যগুলি প্রধানত ইন্টারনেট এবং বিমান বাহিনীতে কর্মরত কয়েকজনের সেীজন্যে পাওয়া।

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে ব্যবহত ট্রেনিং বিমান ও হেলিকপ্টার গুলি হচ্ছে।
১. পিটি-৬(সিজে-৬)। প্রাইমারি প্রপেলার ট্রেইনার।
২.টি-৩৭। বেসিক জেট ট্রেইনার।
৩.এল-৩৯। অ্যাডভান্স জেট ট্রেইনার।
৪.বেল-২০৬ হেলিকপটার।

পিটি-৬ বা প্রাইমারি ট্রেইনার-৬ একটি পিস্টন ইঞ্জিন চালিত প্রশিক্ষন বিমান। এই বিমানটি মুলত সোভিয়েট ডিজাইন অনুসারে চিনের তৈরি। চিনা বিমান বাহিনীতে এই বিমান প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৯৬০ সালে। চিনা বিমান বাহিনীতে এটি সিজে-৬ নামে পরিচিত। ১৯৬০ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯৫-২০০০ সাল পর্যন্ত প্রায় পাঁচহাজার সিজে-৬ বিমান তৈরি হয়েছে। তবে অন্যান্য বিমানের তুলনায় এই বিমানটির মডেল আপগ্রেড হয়েছে খুবই কম। তথাপি বিমানের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত সফল প্রশিক্ষন বিমান হিসেবে এই বিমানটি অনেক উপরে স্থান করে নিয়েছে। চিনা বিমান বাহিনী ছিল এর প্রথম থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত প্রধান ব্যবহারকারী। ১৯৬৫ সালে চিন এই বিমানের একটি মডেল সিজে-৬ এ তৈরি করে। এই মডেলটি বিদেশে রপ্তানী করা হয় পিটি-৬ ও পিটি-৬ এ নামে। তৎকালিন সময়ে উন্নত টেকনলজি এবং সল্প মুল্য ও উড্ডয়ন ব্যায় এবং সহজ রক্ষনাবেক্ষনের সুবিধার জন্য এই বিমানটি খুব দ্রুতই জনপ্রিয় হয়। চিনের পর মধ্যপ্রাচ্য,উত্তর কোরিয়া, আফ্রিকা ও পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি বিমান বাহিনী তাদের প্রধান প্রশিক্ষন বিমান হিসেবে এই বিমানটিকে গ্রহন করে। তবে বর্তমানে চিন ছাড়া আর যে কয়েকটি দেশ এই বিমানটি ব্যবহার করছে সেগুলি হচ্ছে বাংলাদেশ,আলবেনিয়া,উত্তর কোরিয়া,ইকুয়েডর,শ্রীলংকা এবং লাওস।

পিটি-৬ একটিএক ইঞ্জিনের দুই আসন বিশিষ্ট বিমান। বৈমানিক এর আসন বা ককপিট দুটি ট্যানডেম বা একটির পিছনে একটি ভাবে থাকে। উভয় ককপিট থেকেই বিমানটির পুর্ন নিয়ন্ত্রন করা যায়। সাধারনত সামনের দিকের ককপিটে প্রশিক্ষনার্থি এবং পিছনের দিকের ককপিটে প্রশিক্ষক বসেন। এটি মাত্র ২৮ফুট লম্বা এবং এর উইং স্প্যান বা ডানার মোট দৈর্ঘ ৩৩ফুট ৬ ইঞ্চি। সর্বোচ্চ গতি ১৬০ নটিক্যাল মাইল প্রতি ঘন্টায়। এর একটি ইঞ্জিন ও প্রপেলার সামনের দিকে অবস্থিত। সাধারনভাবে কোন অস্ত্র বহন করেনা তবে মেশিনগান ও বোমা বহন করতে পারে। প্রশিক্ষন ছাড়াও পর্যবেক্ষন,এরিয়াল ফোটগ্রাফি ও এরোবেটিকস বা বিমান নিয়ে বিভিন্ন কৈীশল প্রদর্শনের জন্যও এই বিমানটি ব্যবহত হয়। পিটি-৬ বিমান তৈরি হয় প্রধানত চিনের নানচাং এয়ারক্রাফট ম্যানুফ্যাকচারিং ফ্যাক্টরীতে। তবে লাইসেন্স নিয়ে আরো কয়েকটি দেশ এটি উৎপাদন করত। পিটি-৬ বিমান হিসেবে খুবই হালকা এবং ম্যানুয়ালি একে পরিচালনা করতে হয়। রেডিও ছাড়া আর কোন বিশেষ উল্লেখযোগ্য ইলেকট্রনিক যন্ত্র এতে নাই। এই বিমানটি সাধারনত ২৮৫ অশ্বশক্তির একটি পিষ্টন ইঞ্জিন ব্যবহার করে। এখানে উল্লেখ যোগ্য বর্তমানে প্রপেলার চালিত বিমানের জন্য ব্যবহত হয় টারবাইন ইঞ্জিন। পিষ্টন ইঞ্জিন এখন বিমান এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও খুব কমই ব্যবহত হয়।
আধুনিক না হলেও প্রাথমিক প্রশিক্ষনের জন্য এটি একটি উপযুক্ত বিমান।

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে প্রথম এই বিমান যুক্ত হয় ১৯৭৭ সালে। যশোরে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ বিমান বাহিনী একাডেমিতে এই বিমান ব্যবহার করা হচ্ছে আজ পর্যণ্ত। বর্তমানে প্রায় ৩০-৪০ টি পিটি-৬ বিমান রয়েছে। এই বিমানগুলি ১১ স্কোয়াড্রনের আওতা ভুক্ত। যশোরের বিমান বাহিনী একাডেমি ছাড়াও বগুড়ায় অবস্থিত ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর ট্রেনিং স্কুল ও এই বিমান ব্যবহার করে থাকে। এই বিমানগুলি ১৯৭৭-১৯৯২ সালের মধ্যে আমদানি করা হয়েছে। অর্থ্াত এই বিমানগুলি কম পক্ষে আঠারো বছরের পুরনো। তবে নিয়মিত ওভারহল করা হলে একটি বিমান ৪০-৫০ বছর পর্যন্ত কার্যকর থাকতে পারে। পিটি-৬ এর ক্ষেত্রে ওভার হলিং সময় হচ্ছে একহাজার উড্ডয়ন ঘন্টা। অর্থাত প্রতি একহাজার ঘন্টা উড্ডয়নের পর এই বিমান গুলি ওভারহলিং এবং কিছু যন্ত্রাংশ পরিবর্তনের দরকার হয়। প্রশিক্ষন কাজে নিয়োজিত থাকায় এই বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর এই বিমানগুলি সবচেয়ে বেশি সময় উড্ডয়ন করে। ওভার হলিং এর জন্য চিনে পাঠাতে এক সময় প্রচুর অর্থ ব্যায় ও সময় নষ্ট হতো । নব্বই এর দশকে এই বিমানগুলি দেশেই ওভারহল করার ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিস্তু দেশের সর্বগ্রাসী দুর্নিতী এই ক্ষেত্রেও প্রবেশকরে। এই বিমানগুলি ওভারহল করার সময় মানসম্পন্ন যন্ত্রাংশ দ্বারা রিপ্লেসমেন্ট না করার অভিযোগ উঠে। পাশাপালি চিন এই বিমানের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়ায় প্রয়োজনিয় যন্ত্রাংশের অভাবও দেখা দেয়। এমতবস্থায় এই বিমানগুলি চলাচল ঝুঁকি পুর্ন হয়ে যায়। গত কয়েক বছরে এই বিমানগুলিতে বেশকয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে।
পিটি-৬ বিমানগুলির পরিবর্তে নতুন আধুনিক প্রাইমারি ট্রেইনার ক্রয় করার জন্য ১৯৯০ সাল থেকেই আলোচনা হচ্ছে। জেনস ডিফেন্স উইকলি সহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী পাকিস্তান হতে "এমএফআই-১৭ মুশশাক" বিমান সংগ্রহ করতে যাচ্ছে বলে জানা যায় ২০০০ সালের দিকে। কিন্তু এটি মান সম্পন্ন নয় বলে এই প্রষ্তাব বাতিল করা হয়। যদিও এই বিমানটি এবং এর আপগ্রেডেড ভার্সন "সুপার মুশশাক" পাকিস্তান,সৈীদি আরব সহ বেশ কয়েকটি দেশে ব্যবহত হচ্ছে। এই বিমানটি মুলত সুইডেন কর্তক ডিজাইন করা "সাব সাফারী" বিমানের লাইসেন্সড কপি। সুইডেন কতৃক নির্মিত বিমান কয়েকটি ইউরোপিয় বিমান বাহিনীতে ব্যবহত হচ্ছে। তথাপি কোন কারনে এই বিমানটি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়নি। এ অবস্থায় ইউরোপিয় বা মার্কিন মডেলের বিমান সংগ্রহের চেষ্টা নেয়া হলে ও উচ্চ মুল্য সহ বিভিন্ন কারনে তা এখনও সম্ভব হয়নি।
পিটি-৬ বিমান চিনা বিমান বাহিনী ২০১১ সালের মধ্যেই বাতিল করে দিচ্ছে। তার পরিবর্তে আধুনিক পিটি-৭ বিমান সংযোজিত হচ্ছে তাদের বিমান বাহিনীতে। অন্যদিকে সময়মত নতুন বিমান ক্রয় না করায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে ঝুঁকিপুর্ন এই বিমান ব্যবহার করে তাদের অতি গুরুত্বপুর্ন প্রশিক্ষন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে। আরো কোন মায়ের কোল খালি হওয়ার আগেই সরকার এই বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহন করবেন এটিই আমাদের কামনা।