জেনারেল আতাউল গনি ওসমানি। একটি সংগ্রামের ইতিহাস।
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ০১ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ১০:১৯:৪২ সকাল
আজ ১লা সেপ্টেম্বর মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানির জন্মবার্ষিকি। সৎ এই মানুষটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রিয় ক্ষমতার অতি নিকটে অবস্থান করেও কখনও ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেননি। দেশকে ভয়ংকর বিপদজনক পরিস্থিতি হতে রক্ষা করেছিলেন নিজের জিবনের উপর ভয়ংকর ঝুঁকি নিয়ে। শত্রুর আক্রমনের মুখে অকুতোভয় হয়ে দৃঢ়চিত্তে নেতৃত্ব দিয়েছেন স্বাধিনতা সংগ্রামে।
এই বীর সৈনিক এর জন্ম সিলেটের সুনামগঞ্জে ১৯১৮ ইংরেজি সালে। পৈতৃক বাড়ি বর্তমান সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার দয়ামির এ। তার পিতা খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ওসমানি ছিলেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। মা জুবেদা খাতুন। তারা হযরত উসমান (রাঃ) এর বংশদ্ভুত বলে ওসমানি বা উসমানি উপাধি ব্যবহার করেন। তার এদেশে বসবাস কারি প্রথম পুর্বপুরুষ ছিলেন শাহ নিজামউদ্দিন ওসমানি যিনি হযরত শাহজালাল এর সাথে সিলেট আগমন করেছিলেন্। সিলেট তখন আসাম প্রদেশ এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাদের পরিবার ছিল উচ্চ শিক্ষিত। যখন বাংলাভাষি বিশেষ করে মুসলিম গ্রাজুয়েট এর সংখ্যা ছিল প্রতি জেলায় গড়ে একজনেরও কম তখনই তাদের পরিবারে চারজন গ্রাজুয়েট ও মাস্টার্স ডিগ্রিধারি ছিলেন। সিলেট সরকারি হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পরিক্ষা উত্তির্ন হয়ে তিনি আলিগড় যান। সেখান থেকে এফ,এ ও বি,এ পরিক্ষায় উত্তির্ন হন। ভুগোলে মাষ্টার্স এর ছাত্র থাকা কালে ১৯৩৮ সালে তিনি তৎকালিন বৃটিশ ভারতিয় সেনাবাহিনীতে যোগদেন। দেরাদুনে ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি থেকে ১৯৪০ সালের অক্টোবর মাসে কমিশন লাভ করেন। তিনি ইন্ডিয়ান আর্মি সার্ভিস কোর এ পোস্টিং পান। উল্লেখযোগ্য তখন সাধারনত কোন ভারতিয় অফিসারকে পদাতিক বা সাজোঁয়া বাহিনিতে পোষ্টিং দেয়া হতোনা এবং বিশেষ করে বাঙ্গালি কোন অফিসারকে তো নয়ই। আর্টিলারি বা গোলন্দাজ বাহিনীর জন্য নির্বাচিত ও প্রশিক্ষিত হলেও এই নিতির জন্য তাকে সরবরাহ বা সাপ্লাই এন্ড ট্রান্সপোর্ট বাহিনীতে নিয়োগ করা হয়। পরবর্তিতে দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধ পুর্বভারত পর্যন্ত বিস্তৃত হলে এই নিতি পরিতক্ত হয়। জেনারেল ওসমানি সেকেন্ড লেফটেনান্ট হিসেবে একটি সাপ্লাই ডিপোতে অফিসার হিসেবে যোগ দেন। এরপর তাকে মোটর ট্রান্সপোর্ট ব্যাটালিয়নের সাথে তৎকালিন বার্মা ফ্রন্টে প্রেরন করাহয়। ১৯৪১ সালে তিনি ক্যাপ্টেন পদে উন্নিত হন। ১৯৪২ সালে তিনি অস্থায়ি মেজর পদে উন্নিত হন। তৎকালিন বিশাল বৃটিশ সেনাবাহিনীতে তিনিই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ মেজর। মেজর র্যাংক এই তিনি বার্মা ফ্রন্টে একটি মোটরাইজড ট্রান্সপোর্ট ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্বপালন করেন যা সাধারনত লেঃকর্নেল র্যাংক এর জন্য নির্ধারিত। দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তি ও উপমহাদেশের স্বাধিনতার পর তিনি পাকিস্তানের পক্ষে অপশন দেন। ১৯৪৭ সালে তিনি লেফটেনান্ট কর্নেল পদে উন্নিত হন এবং কোয়েটা স্টাফ কলেজ থেকে পিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। জেনারেল ওসমানি স্বেচ্ছায় আবার মেজর র্যাংক এ রিভার্সন গ্রহন করেন এবং পাকিস্তানে পদাতিক বাহিনীতে যোগদেন। মেজর ও লেঃকর্নেল হিসেবে তিনি পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ও পাকিস্তান আর্মির হেডকোয়ার্টারএ গুরুত্বপুর্ন দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫১ সালে পুনরায় লেঃ কর্নেল পদে উন্নিত হন এবং ৫/১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এর কমান্ডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এরপর ৯/১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এরও অধিনায়ক হিসেবে ছিলেন। ১৯৫৩ সালে প্রথম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্বগ্রহন করেন। এই ব্যাটালিয়ন ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য সবচেয়ে বেশি পদক লাভ করে। আর বাংলাদেশের স্বাধিনতা যুদ্বে এই ব্যাটালিয়ন সহ ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট এর অবদান আলোচনার অপেক্ষা রাখেনা। ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর অগ্রযাত্রায় তার অবদান অপিরিসিম। তিনি তৎকালিন ইপিআর এর উপ-পরিচালক হিসেবেও কাজ করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি চট্টগ্রামে ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার এর কমান্ডেন্ট পদে যোগ দেন। এরপর ১৯৫৬ সালে কর্নেল পদে উন্নিত হন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে স্টাফ অফিসার হিসেবে যোগ দেন। মাত্র ১৬ বছরে সেকেন্ড লেফটেনান্ট হতে কর্নেল পদে উন্নিত হলেও তৎকালিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙ্গালি বিরোধি দৃষ্টিভঙ্গি ও অন্যান্য ঔপনিবেশিক মানসিকতার জন্য তিনি এরপর আর প্রমোশন পাননি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তখন এবং এখনও পুর্নাঙ্গ কর্নেল পদে অবসর গ্রহন করার ঘটনা খুবই কম। স্ট্রাকচার অনুযায়ি কেউ এক থেকে চার বছরের বেশি কর্নেল পদে থাকেননা। এবং কর্নেল পদে পদন্নোতি পেলেই ধনে নেয়া হতো তিনি যথাসময়ে ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নিত হবেন। কিন্তু কর্নেল ওসমানির বাঙ্গালি মানসিকতা এবং সোজাসাপ্টা স্পষ্টবাদি আচরন তার প্রতি তৎকালিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের বিদ্বেষ পরায়ন করে তোলে। তারা তিনি আর্মি সার্ভিস কোরের অফিসার ছিলেন বলে উচ্চ পদের জন্য অযোগ্য বলে প্রচার করে। তখন পাকিস্থান সেনাবাহিনীতে পদাতিক ও সাঁজোয়া ছাড়া অন্য কোরের সদস্যদের কে হীন চোখে দেখা হতো। অথচ জেনারেল ওসমানি দক্ষতার সাথে তিনটি পদাতিক ব্যাটালিয়নের নেতৃত্বদেন। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অতি গুরুত্বপুর্ন অপারেশন অধিদপ্তরে উপপরিচালক হিসেবে যোগদেন। ১৯৬৫ সালের পাক- ভারত যুদ্ধের সময় তিনি এই পদে ছিলেন। এই দপ্তরের দায়িত্ব সামরিক বাহিনীর সকল অপারেশনাল ও যুদ্ধ সংক্রান্ত কার্যক্রম নিয়ন্ত্রন ও পরিকল্পনা। তাকে এই সময় সার্ভিসে তার জুনিয়র অফিসারদের অধিনে কাজ করতে হয়েছিল কিন্তু তথাপি তিনি দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথেই তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে তার চাকরির পচিশ বছর অতিক্রান্ত হলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে সন্মানজনকভাবে অবসর প্রদান করে। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থাকতে সবসময় বাঙ্গালি সৈনিকদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন এবং ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার এর কমান্ডন্ট ও সামরিক হেডকোয়র্টারে কর্মরত থাকার সময় তার অবদানের জন্য তখন থেকেই পাপা টাইগার নামে খ্যাত ছিলেন। অবসর গ্রহনের পর তিনি সিলেটে বসবাস করতে থাকেন। যদিও পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে প্রাপ্য সন্মান প্রদান করেনি তথাপি ব্যাক্তিগত ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারদের অনেকই তাকে সন্মান করতেন এবং পুর্ব পাকিস্তানে উচ্চপদে পোষ্টিং পাওয়া অনেক অফিসারই তার সাথে দেখা করে যেতেন। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে এলাকার জনগনের দাবিতে রাজনিতিতে যোগদেন এবং আওয়ামি লিগের টিকেটে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তিনি বুঝে নেন যে পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেনা। তিনি তৎকালিন কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত বাঙ্গালী সৈনিকদের একত্রিত করা শুরু করেন। কিন্তু তৎকালিন আওয়ামি লীগ নেতৃত্ব প্রকৃত অবস্থা অনুধাবনে ব্যার্থ হয় এবং ২৫শে মার্চ পাক সেনাবাহিনীর অভিযানেরমুখে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তিনি সেদিনই রাতে ঢাকা ত্যাগ করেন এবং অনেক কষ্টে হবিগঞ্জেরে তেলিয়াপারা দিয়ে সিমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যান। ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরে অস্থায়ি সরকার গঠিত হলে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এর পদ গ্রহন করেন। দক্ষ ও দেশপ্রেমিক অফিসার হওয়ার কারনে তিনি সেসময় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অনেকের কাছেই অপছন্দনিয় ছিলেন। প্রবল জাতিয়তাবাদী ওসমানিকে ভারতিয় সরকার ও সেনাবাহিনীও ভয় করে চলত। ভারতিয় সেনাবাহিনীর যেসকল অফিসার ১৯৭১ সালের মুক্তি যুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন তাদের সবাই ই তার অবদান এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। বর্তমান সরকার কতৃক বিশেষ ভাবে সন্মানিত ভারতিয় সেনাবাহিনীর ইহুদি লেঃজেঃ জেএফআর জ্যাকব লিখেছেন তার সাথে কাজ করা নাকি তার পক্ষে কঠিন ছিল। তিনি মুক্তি যুদ্ধের একপর্যায়ে ভারতিয় চাপে থাকা তৎকালিন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিরোধ হওয়ায় পদত্যাগ করেছিলেন কিন্তু অন্যান্য অফিসার ও মুক্তিযোদ্ধাদের তিব্র প্রতিবাদ ও দাবির মুখে তা প্রত্যাহার করেন। কিন্তু ভারতিয়রা তাকে ভয় করতো বলে চুড়ান্ত বিজয়ের সময় পাকবাহিনীর আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে তাকে উপস্থিত থাকতে দেয়া হয়নি। স্বাধিন বাংলাদেশে তিনি ১৯৭২ সালের ৭ই এপ্রিল পর্যন্ত তিনি সর্বাধিনায়ক এর পদে থাকেন এবং এরপর পুর্নাঙ্গ জেনারেল র্যাংক এ অবসর নিয়ে তৎকালিন মন্ত্রিসভায় নৈী ও বিমান চলাচল বিষয়ক মন্ত্রি হিসেবে যোগদেন।
ওসমানি স্বাধিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারদের আত্মিকরনের পক্ষে বলিষ্ঠ ভুমিকা পালন করেন। এমনকি সেময় মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের যে দুই বছর সিনিয়রিটি দেয়া হয় তারও প্রবল প্রতিবাদ করেন ওসমানি। ১৯৭৩ সালে তিনি আবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং মন্ত্রিসভায় যোগদেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কে খুবই শ্রদ্ধা করলেও তার নিতির সাথে তিনি একমত ছিলেননা। ১৯৭৫ সালের শুরুতে যখন একদলিয় শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয় তখন তিনি এর তিব্র প্রতিবাদ করেন। দলিয় বৈঠকে যখন প্রায় সকলেই এর পক্ষে বক্তব্য দিচ্ছিল তখন তিনি শেখ মুজিবর রহমানের উদ্দেশ্যে বলেন যে আমরা ইয়াহিয়া খানকে সরিয়ে কোন মুজিব খানকে চাইনা। শেষ পর্যন্ত এপ্রিল মাসে একদলিয় বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি এর প্রতিবাদে সংসদ সদস্য ও দলিয় পদ থেকে পদত্যাগ করেন। বাকশালি শাসন এর প্রতিবাদে তিনিই প্রথম আওয়াজ তুলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট শেখ মুজিবর রহমান নিহত হলে তিনি খন্দকার মুশতাক এর সরকারে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন। ৩রা নভেম্বর খালেদ মুশাররফ এর নেতৃত্বে যে বিদ্রোহ হয় তিনি এই বিদ্রোহ প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। সফল না হলেও যখন শাফায়াত জামিল এর নেতৃত্বে কয়েকজন তরুন অফিসার বঙ্গভবনে বৈঠকরত তৎকালিন মন্ত্রিসভার বৈঠকে অস্ত্র সহ প্রবেশ করে ও গুলি চালানর চেষ্টা করে তখন অকুতভয় জেনারেল ওসমানি নিজের জিবনের ঝুকি নিয়ে তাদের প্রতিরোধ করেন। এরপর ৭ই নভেম্বর সিপাহি বিপ্লবের সময় তিনি আবারও বঙ্গভবনে যান এবং এবারও দেশকে দঙ্গা হাঙ্গামা ও গৃহযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি এ সময় ক্ষমতার অতি কাছে ছিলেন এবং সামান্য চেষ্টা করলেই তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চপদ অধিকার করতে পারতেন কিন্তু তিনি সেই চেষ্টাও করেননি।
বিচারপতি আবু সাদাত মুহাম্মদ সায়েম এর নেতৃত্ব প্রথমে সরকার গঠিত হয় এবং তার পর জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বে সরকার পরিচালিত হয়। জেনারেল ওসমানি ১৯৭৬ সালে জাতিয় জনতা পার্টি গঠন করেন এবং ১৯৭৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেনারেল জিয়াউর রহমানে বিরুদ্ধে আওয়ামিলিগ সহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল সমর্থিত প্রার্থি হিসেবে প্রতিদদ্বিতা করেন। ১৯৮১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও তিনি প্রতিদদ্বিতা করেন সতন্ত্র প্রার্থি হিসেবে। এসময় তিনি সিলেটেই সাধারনত অবস্থান করতেন এবং বিভিন্ন জাতিয় বিষয়ে মতামত ও পরামর্শ দিতেন। ১৯৮৪ সালের ১৬ ই ফেব্রুয়ারি এই মহান যোদ্ধা লন্ডনে ইন্তেকাল করেন। তাকে সিলেটে হযরত শাহজালালের মাজার সংলগ্ন কবরস্থানে দাফন করা হয়।
চিরকুমার জেনারেল ওসমানি ছিলেন একজন অত্যন্ত সৎ ব্যাক্তি। অতি সাধারন জিবনযাপন করতেন তিনি। সৈনিকদের মত ক্যাম্পখাটে ঘুমাতেন। মগে করে চা পার করতেন। সাধারনত গেঞ্জি পাজামা পরে থাকতেন ঘরে। অনুষ্ঠানে শেরওয়ানি বা পাজামা পাঞ্জাবি পরে যেতেন। সিলেটে তার পেনশনের টাকায় ও উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির আয় দিয়ে জিবন কাটাতেন। একটি পুরোন গাড়ি ছিল যা সামরিক বাহিনিতে কর্মরত অবস্থায় কিনেছিলেন।
ব্যাক্তিগত শ্রদ্ধা কখনও তাকে সত্য ও ন্যায়পরায়নপরতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। আবার ব্যাক্তিগত বিরোধও কারো প্রতি প্রাপ্য সন্মান দেয়ায় বাধা দেয়নি।
শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি আমৃত্য শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন কিন্তু তার নিতির প্রশ্নে তিব্র সমালোচনা করেছেন। বিশিষ্ট ও প্রবিন রাজনিতিবিদ রা যখন বাকশালে যোগ দিচ্ছেন কিংবা নিরব থেকেছেন তখন নবিন রাজনিতিক হয়েও ন্যায়ের পক্ষে উচ্চ কণ্ঠে প্রতিবাদ করেছেন এবং সাহসের সাথে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছেন আজিবন গনতন্ত্রের সমর্থক এই ব্যাক্তি। আবার ১৯৭৫ সাল থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমানের সাথে ব্যাক্তিগত পর্যায়ে বিরোধ থাকলেও এবং তার বিপক্ষে নির্বাচনে প্রার্থি হলেও জিয়ার শাহাদাতের পর তিনি তার জানাজার প্রথম সারিতে উপস্থিত থেকেছেন। তাকে কবরে নামানর সময় পাশে ছিলেন এবং প্রথম কবর জিয়ারত করে সামরিক ষ্টাইলে সন্মান প্রদর্শন করেছেন। বাংলাদেশকে স্বাধিন ও সার্বভৈীম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠায় তার অবদান সর্বোচ্চ। কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমানে তিনি যেন হারিয়ে গেছেন নতুন প্রজন্মের সম্মুখ থেকে। স্বাধিনতার সংগ্রাম তো এখন একনেতা ও একদলের ব্যাক্তিগত সম্পত্তি হয়ে গেছে। আর মিডিয়াও এই প্রবল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধি ব্যাক্তিটিকে এখন এড়িয়ে চলতেই ইচ্ছূক কারন জেনারেল ওসমানি তার স্বাধিন মানসিকতার জন্য তৎকালিন ভারত সরকারের চক্ষুশুল ছিলেন। তার সেই মানসিকতার জন্য আজ তথাকথিত সুশীল মিডিয়ার কাছেও তিনি গ্রহনযোগ্য নন। কিন্তু যতই চেষ্টা করা হোক বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে তার নাম মুছে ফেলা অসম্ভব।
এই বীর সৈনিক এর জন্ম সিলেটের সুনামগঞ্জে ১৯১৮ ইংরেজি সালে। পৈতৃক বাড়ি বর্তমান সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার দয়ামির এ। তার পিতা খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ওসমানি ছিলেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। মা জুবেদা খাতুন। তারা হযরত উসমান (রাঃ) এর বংশদ্ভুত বলে ওসমানি বা উসমানি উপাধি ব্যবহার করেন। তার এদেশে বসবাস কারি প্রথম পুর্বপুরুষ ছিলেন শাহ নিজামউদ্দিন ওসমানি যিনি হযরত শাহজালাল এর সাথে সিলেট আগমন করেছিলেন্। সিলেট তখন আসাম প্রদেশ এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাদের পরিবার ছিল উচ্চ শিক্ষিত। যখন বাংলাভাষি বিশেষ করে মুসলিম গ্রাজুয়েট এর সংখ্যা ছিল প্রতি জেলায় গড়ে একজনেরও কম তখনই তাদের পরিবারে চারজন গ্রাজুয়েট ও মাস্টার্স ডিগ্রিধারি ছিলেন। সিলেট সরকারি হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পরিক্ষা উত্তির্ন হয়ে তিনি আলিগড় যান। সেখান থেকে এফ,এ ও বি,এ পরিক্ষায় উত্তির্ন হন। ভুগোলে মাষ্টার্স এর ছাত্র থাকা কালে ১৯৩৮ সালে তিনি তৎকালিন বৃটিশ ভারতিয় সেনাবাহিনীতে যোগদেন। দেরাদুনে ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি থেকে ১৯৪০ সালের অক্টোবর মাসে কমিশন লাভ করেন। তিনি ইন্ডিয়ান আর্মি সার্ভিস কোর এ পোস্টিং পান। উল্লেখযোগ্য তখন সাধারনত কোন ভারতিয় অফিসারকে পদাতিক বা সাজোঁয়া বাহিনিতে পোষ্টিং দেয়া হতোনা এবং বিশেষ করে বাঙ্গালি কোন অফিসারকে তো নয়ই। আর্টিলারি বা গোলন্দাজ বাহিনীর জন্য নির্বাচিত ও প্রশিক্ষিত হলেও এই নিতির জন্য তাকে সরবরাহ বা সাপ্লাই এন্ড ট্রান্সপোর্ট বাহিনীতে নিয়োগ করা হয়। পরবর্তিতে দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধ পুর্বভারত পর্যন্ত বিস্তৃত হলে এই নিতি পরিতক্ত হয়। জেনারেল ওসমানি সেকেন্ড লেফটেনান্ট হিসেবে একটি সাপ্লাই ডিপোতে অফিসার হিসেবে যোগ দেন। এরপর তাকে মোটর ট্রান্সপোর্ট ব্যাটালিয়নের সাথে তৎকালিন বার্মা ফ্রন্টে প্রেরন করাহয়। ১৯৪১ সালে তিনি ক্যাপ্টেন পদে উন্নিত হন। ১৯৪২ সালে তিনি অস্থায়ি মেজর পদে উন্নিত হন। তৎকালিন বিশাল বৃটিশ সেনাবাহিনীতে তিনিই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ মেজর। মেজর র্যাংক এই তিনি বার্মা ফ্রন্টে একটি মোটরাইজড ট্রান্সপোর্ট ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্বপালন করেন যা সাধারনত লেঃকর্নেল র্যাংক এর জন্য নির্ধারিত। দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তি ও উপমহাদেশের স্বাধিনতার পর তিনি পাকিস্তানের পক্ষে অপশন দেন। ১৯৪৭ সালে তিনি লেফটেনান্ট কর্নেল পদে উন্নিত হন এবং কোয়েটা স্টাফ কলেজ থেকে পিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। জেনারেল ওসমানি স্বেচ্ছায় আবার মেজর র্যাংক এ রিভার্সন গ্রহন করেন এবং পাকিস্তানে পদাতিক বাহিনীতে যোগদেন। মেজর ও লেঃকর্নেল হিসেবে তিনি পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ও পাকিস্তান আর্মির হেডকোয়ার্টারএ গুরুত্বপুর্ন দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫১ সালে পুনরায় লেঃ কর্নেল পদে উন্নিত হন এবং ৫/১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এর কমান্ডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এরপর ৯/১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এরও অধিনায়ক হিসেবে ছিলেন। ১৯৫৩ সালে প্রথম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্বগ্রহন করেন। এই ব্যাটালিয়ন ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য সবচেয়ে বেশি পদক লাভ করে। আর বাংলাদেশের স্বাধিনতা যুদ্বে এই ব্যাটালিয়ন সহ ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট এর অবদান আলোচনার অপেক্ষা রাখেনা। ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর অগ্রযাত্রায় তার অবদান অপিরিসিম। তিনি তৎকালিন ইপিআর এর উপ-পরিচালক হিসেবেও কাজ করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি চট্টগ্রামে ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার এর কমান্ডেন্ট পদে যোগ দেন। এরপর ১৯৫৬ সালে কর্নেল পদে উন্নিত হন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে স্টাফ অফিসার হিসেবে যোগ দেন। মাত্র ১৬ বছরে সেকেন্ড লেফটেনান্ট হতে কর্নেল পদে উন্নিত হলেও তৎকালিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙ্গালি বিরোধি দৃষ্টিভঙ্গি ও অন্যান্য ঔপনিবেশিক মানসিকতার জন্য তিনি এরপর আর প্রমোশন পাননি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তখন এবং এখনও পুর্নাঙ্গ কর্নেল পদে অবসর গ্রহন করার ঘটনা খুবই কম। স্ট্রাকচার অনুযায়ি কেউ এক থেকে চার বছরের বেশি কর্নেল পদে থাকেননা। এবং কর্নেল পদে পদন্নোতি পেলেই ধনে নেয়া হতো তিনি যথাসময়ে ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নিত হবেন। কিন্তু কর্নেল ওসমানির বাঙ্গালি মানসিকতা এবং সোজাসাপ্টা স্পষ্টবাদি আচরন তার প্রতি তৎকালিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের বিদ্বেষ পরায়ন করে তোলে। তারা তিনি আর্মি সার্ভিস কোরের অফিসার ছিলেন বলে উচ্চ পদের জন্য অযোগ্য বলে প্রচার করে। তখন পাকিস্থান সেনাবাহিনীতে পদাতিক ও সাঁজোয়া ছাড়া অন্য কোরের সদস্যদের কে হীন চোখে দেখা হতো। অথচ জেনারেল ওসমানি দক্ষতার সাথে তিনটি পদাতিক ব্যাটালিয়নের নেতৃত্বদেন। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অতি গুরুত্বপুর্ন অপারেশন অধিদপ্তরে উপপরিচালক হিসেবে যোগদেন। ১৯৬৫ সালের পাক- ভারত যুদ্ধের সময় তিনি এই পদে ছিলেন। এই দপ্তরের দায়িত্ব সামরিক বাহিনীর সকল অপারেশনাল ও যুদ্ধ সংক্রান্ত কার্যক্রম নিয়ন্ত্রন ও পরিকল্পনা। তাকে এই সময় সার্ভিসে তার জুনিয়র অফিসারদের অধিনে কাজ করতে হয়েছিল কিন্তু তথাপি তিনি দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথেই তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে তার চাকরির পচিশ বছর অতিক্রান্ত হলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে সন্মানজনকভাবে অবসর প্রদান করে। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থাকতে সবসময় বাঙ্গালি সৈনিকদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন এবং ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার এর কমান্ডন্ট ও সামরিক হেডকোয়র্টারে কর্মরত থাকার সময় তার অবদানের জন্য তখন থেকেই পাপা টাইগার নামে খ্যাত ছিলেন। অবসর গ্রহনের পর তিনি সিলেটে বসবাস করতে থাকেন। যদিও পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে প্রাপ্য সন্মান প্রদান করেনি তথাপি ব্যাক্তিগত ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারদের অনেকই তাকে সন্মান করতেন এবং পুর্ব পাকিস্তানে উচ্চপদে পোষ্টিং পাওয়া অনেক অফিসারই তার সাথে দেখা করে যেতেন। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে এলাকার জনগনের দাবিতে রাজনিতিতে যোগদেন এবং আওয়ামি লিগের টিকেটে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তিনি বুঝে নেন যে পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেনা। তিনি তৎকালিন কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত বাঙ্গালী সৈনিকদের একত্রিত করা শুরু করেন। কিন্তু তৎকালিন আওয়ামি লীগ নেতৃত্ব প্রকৃত অবস্থা অনুধাবনে ব্যার্থ হয় এবং ২৫শে মার্চ পাক সেনাবাহিনীর অভিযানেরমুখে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তিনি সেদিনই রাতে ঢাকা ত্যাগ করেন এবং অনেক কষ্টে হবিগঞ্জেরে তেলিয়াপারা দিয়ে সিমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যান। ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরে অস্থায়ি সরকার গঠিত হলে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এর পদ গ্রহন করেন। দক্ষ ও দেশপ্রেমিক অফিসার হওয়ার কারনে তিনি সেসময় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অনেকের কাছেই অপছন্দনিয় ছিলেন। প্রবল জাতিয়তাবাদী ওসমানিকে ভারতিয় সরকার ও সেনাবাহিনীও ভয় করে চলত। ভারতিয় সেনাবাহিনীর যেসকল অফিসার ১৯৭১ সালের মুক্তি যুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন তাদের সবাই ই তার অবদান এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। বর্তমান সরকার কতৃক বিশেষ ভাবে সন্মানিত ভারতিয় সেনাবাহিনীর ইহুদি লেঃজেঃ জেএফআর জ্যাকব লিখেছেন তার সাথে কাজ করা নাকি তার পক্ষে কঠিন ছিল। তিনি মুক্তি যুদ্ধের একপর্যায়ে ভারতিয় চাপে থাকা তৎকালিন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিরোধ হওয়ায় পদত্যাগ করেছিলেন কিন্তু অন্যান্য অফিসার ও মুক্তিযোদ্ধাদের তিব্র প্রতিবাদ ও দাবির মুখে তা প্রত্যাহার করেন। কিন্তু ভারতিয়রা তাকে ভয় করতো বলে চুড়ান্ত বিজয়ের সময় পাকবাহিনীর আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে তাকে উপস্থিত থাকতে দেয়া হয়নি। স্বাধিন বাংলাদেশে তিনি ১৯৭২ সালের ৭ই এপ্রিল পর্যন্ত তিনি সর্বাধিনায়ক এর পদে থাকেন এবং এরপর পুর্নাঙ্গ জেনারেল র্যাংক এ অবসর নিয়ে তৎকালিন মন্ত্রিসভায় নৈী ও বিমান চলাচল বিষয়ক মন্ত্রি হিসেবে যোগদেন।
ওসমানি স্বাধিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারদের আত্মিকরনের পক্ষে বলিষ্ঠ ভুমিকা পালন করেন। এমনকি সেময় মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের যে দুই বছর সিনিয়রিটি দেয়া হয় তারও প্রবল প্রতিবাদ করেন ওসমানি। ১৯৭৩ সালে তিনি আবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং মন্ত্রিসভায় যোগদেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কে খুবই শ্রদ্ধা করলেও তার নিতির সাথে তিনি একমত ছিলেননা। ১৯৭৫ সালের শুরুতে যখন একদলিয় শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয় তখন তিনি এর তিব্র প্রতিবাদ করেন। দলিয় বৈঠকে যখন প্রায় সকলেই এর পক্ষে বক্তব্য দিচ্ছিল তখন তিনি শেখ মুজিবর রহমানের উদ্দেশ্যে বলেন যে আমরা ইয়াহিয়া খানকে সরিয়ে কোন মুজিব খানকে চাইনা। শেষ পর্যন্ত এপ্রিল মাসে একদলিয় বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি এর প্রতিবাদে সংসদ সদস্য ও দলিয় পদ থেকে পদত্যাগ করেন। বাকশালি শাসন এর প্রতিবাদে তিনিই প্রথম আওয়াজ তুলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট শেখ মুজিবর রহমান নিহত হলে তিনি খন্দকার মুশতাক এর সরকারে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন। ৩রা নভেম্বর খালেদ মুশাররফ এর নেতৃত্বে যে বিদ্রোহ হয় তিনি এই বিদ্রোহ প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। সফল না হলেও যখন শাফায়াত জামিল এর নেতৃত্বে কয়েকজন তরুন অফিসার বঙ্গভবনে বৈঠকরত তৎকালিন মন্ত্রিসভার বৈঠকে অস্ত্র সহ প্রবেশ করে ও গুলি চালানর চেষ্টা করে তখন অকুতভয় জেনারেল ওসমানি নিজের জিবনের ঝুকি নিয়ে তাদের প্রতিরোধ করেন। এরপর ৭ই নভেম্বর সিপাহি বিপ্লবের সময় তিনি আবারও বঙ্গভবনে যান এবং এবারও দেশকে দঙ্গা হাঙ্গামা ও গৃহযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি এ সময় ক্ষমতার অতি কাছে ছিলেন এবং সামান্য চেষ্টা করলেই তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চপদ অধিকার করতে পারতেন কিন্তু তিনি সেই চেষ্টাও করেননি।
বিচারপতি আবু সাদাত মুহাম্মদ সায়েম এর নেতৃত্ব প্রথমে সরকার গঠিত হয় এবং তার পর জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বে সরকার পরিচালিত হয়। জেনারেল ওসমানি ১৯৭৬ সালে জাতিয় জনতা পার্টি গঠন করেন এবং ১৯৭৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেনারেল জিয়াউর রহমানে বিরুদ্ধে আওয়ামিলিগ সহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল সমর্থিত প্রার্থি হিসেবে প্রতিদদ্বিতা করেন। ১৯৮১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও তিনি প্রতিদদ্বিতা করেন সতন্ত্র প্রার্থি হিসেবে। এসময় তিনি সিলেটেই সাধারনত অবস্থান করতেন এবং বিভিন্ন জাতিয় বিষয়ে মতামত ও পরামর্শ দিতেন। ১৯৮৪ সালের ১৬ ই ফেব্রুয়ারি এই মহান যোদ্ধা লন্ডনে ইন্তেকাল করেন। তাকে সিলেটে হযরত শাহজালালের মাজার সংলগ্ন কবরস্থানে দাফন করা হয়।
চিরকুমার জেনারেল ওসমানি ছিলেন একজন অত্যন্ত সৎ ব্যাক্তি। অতি সাধারন জিবনযাপন করতেন তিনি। সৈনিকদের মত ক্যাম্পখাটে ঘুমাতেন। মগে করে চা পার করতেন। সাধারনত গেঞ্জি পাজামা পরে থাকতেন ঘরে। অনুষ্ঠানে শেরওয়ানি বা পাজামা পাঞ্জাবি পরে যেতেন। সিলেটে তার পেনশনের টাকায় ও উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির আয় দিয়ে জিবন কাটাতেন। একটি পুরোন গাড়ি ছিল যা সামরিক বাহিনিতে কর্মরত অবস্থায় কিনেছিলেন।
ব্যাক্তিগত শ্রদ্ধা কখনও তাকে সত্য ও ন্যায়পরায়নপরতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। আবার ব্যাক্তিগত বিরোধও কারো প্রতি প্রাপ্য সন্মান দেয়ায় বাধা দেয়নি।
শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি আমৃত্য শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন কিন্তু তার নিতির প্রশ্নে তিব্র সমালোচনা করেছেন। বিশিষ্ট ও প্রবিন রাজনিতিবিদ রা যখন বাকশালে যোগ দিচ্ছেন কিংবা নিরব থেকেছেন তখন নবিন রাজনিতিক হয়েও ন্যায়ের পক্ষে উচ্চ কণ্ঠে প্রতিবাদ করেছেন এবং সাহসের সাথে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছেন আজিবন গনতন্ত্রের সমর্থক এই ব্যাক্তি। আবার ১৯৭৫ সাল থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমানের সাথে ব্যাক্তিগত পর্যায়ে বিরোধ থাকলেও এবং তার বিপক্ষে নির্বাচনে প্রার্থি হলেও জিয়ার শাহাদাতের পর তিনি তার জানাজার প্রথম সারিতে উপস্থিত থেকেছেন। তাকে কবরে নামানর সময় পাশে ছিলেন এবং প্রথম কবর জিয়ারত করে সামরিক ষ্টাইলে সন্মান প্রদর্শন করেছেন। বাংলাদেশকে স্বাধিন ও সার্বভৈীম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠায় তার অবদান সর্বোচ্চ। কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমানে তিনি যেন হারিয়ে গেছেন নতুন প্রজন্মের সম্মুখ থেকে। স্বাধিনতার সংগ্রাম তো এখন একনেতা ও একদলের ব্যাক্তিগত সম্পত্তি হয়ে গেছে। আর মিডিয়াও এই প্রবল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধি ব্যাক্তিটিকে এখন এড়িয়ে চলতেই ইচ্ছূক কারন জেনারেল ওসমানি তার স্বাধিন মানসিকতার জন্য তৎকালিন ভারত সরকারের চক্ষুশুল ছিলেন। তার সেই মানসিকতার জন্য আজ তথাকথিত সুশীল মিডিয়ার কাছেও তিনি গ্রহনযোগ্য নন। কিন্তু যতই চেষ্টা করা হোক বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে তার নাম মুছে ফেলা অসম্ভব।
বিষয়: বিবিধ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন