সোমবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

১ম ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে যারা জিবনের বিনিময়ে রক্ষা করেছিল লাহোর কে।

১ম ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে যারা জিবনের বিনিময়ে রক্ষা করেছিল লাহোর কে।

লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ১১:০৬:১৩ রাত
আগামি কাল ৬ই সেপ্টেম্বর। ১৯৬৫ সালের এই দিনে বিশাল ও উন্নত অস্ত্রসজ্জিত ভারতিয় বাহিনী আক্রমন করেছিল তৎকালিন যুক্ত পাকিস্তান। বিভক্ত পাঞ্জাব প্রদেশের সিমান্ত থেকে পাকিস্তানি পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানি ঐতিহাসিক শহর লাহোরের দুরত্ব ছিল মাত্র ৩০ মাইল। অত্যাধুনিক ট্যাংক ও জঙ্গি বিমান সজ্জিত ভারতিয় বাহিনী তাদের বিশালত্ব এবং সামরিক শক্তির উপর এতই আস্থাবান ছিল যে ভারতিয় সেনাপ্রধান জেনারেল জয়ন্ত নাথ চেীধুরি লাহোরের বিখ্যাত জিমখানা ক্লাবে লাঞ্চ এর দাওয়াত অগ্রিম দিয়ে দিয়েছিলেন সাংবাদিক এবং মন্ত্রিদের। কিন্তু এই বিশাল বাহিনী তার লক্ষ অর্জনে ব্যার্থ হয়। জয়ন্ত নাথ চেীধুরির দাওয়াত কখনই আর খাওয়া হয়নি। ভারতিয় সেনা প্রধানের এই সপ্ন যারা ভেঙ্গে দিয়েছিল তাদের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন আবদান রেখেছিল তৎকালিন ১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। ১৯৬৫ সালে ১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল তৎকালিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১১ ডিভিশনের ১০৬ ব্রিগেড এর অধিনে। ডিভিশন অধিনায়ক ছিলেন মেজর জেনারেল আবদুল হামিদ যিনি ১৯৭১ সালে পাক সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন। ব্রিগেড অধিনায়ক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার নওয়াজিস। আগষ্ট মাসের শেষ দিকেই এই বাহিনীকে লাহোর সিমান্তে মোতায়েন করা হয়। এই সিমান্ত ছিল পুরোপুরি সমতল একটি এলাকা। কৃত্রিমভাবে তৈরি বিআরবি খাল টি ছাড়া সিমান্ত থেকে লাহোর পর্যন্ত কোন প্রাকৃতিক বাধা ছিলনা। এই সেক্টরে গুরুত্বপুর্ন বেদিয়ান এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয় ১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কে। এই রেজিমেন্ট এর তৎকালিন অধিনায়ক ছিলেন বাংলার বীর সেনানি লেফটেনান্ট কর্নেল এটিকে হক। কর্নেল হক দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। পাকিস্তান স্বাধিন হওয়ার পর প্রথমে পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ও পরে ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট এর অফিসার হিসেবে কাজ করেন। উপঅধিনায়ক ছিলেন মেজর মং খিউ। তিনি ছিলেন একজন রাখাইন উপজাতিয় অফিসার। তার বাড়ি কক্সবাজারের হ্নিলায়। তিনি ভারত বিভক্তির আগে আসাম রাইফেলস এ কমিশন পান। ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তানে বন্দি ছিলেন এবং দেশে ফিরে এসে সল্প সময় সেনাবাহিনীতে চাকরি করে অবসর নেন এবং বিআরটিসিতে চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১০ সালে তিনি মৃত্যবরন করেন। লেফটেনান্ট জিয়াউদ্দিন অ্যাডজুটেন্ট এর দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে তিনি লেঃ কর্নেল( অবঃ) জিয়াউদ্দিন বীর উত্তম। কোয়ার্টার মাস্টার ছিলেন লেফটেনান্ট সাদেকুর রহমান যিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পরবর্তিতে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন। বর্তমানে মরহুম। "এ" বা আলফা কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন তৎকালিন ক্যাপ্টেন শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তার সম্পর্কে কিছু বলাই বাহুল্য। অন্য তিনটি কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন তিনজন পাঞ্জাবি মেজর ও ক্যাপ্টেন।সদ্য কমিশন প্রাপ্ত সেকেন্ড লেফটেনান্ট মাহমুদুল হাসান ও ছিলেন এই রেজিমেন্ট এ যিনি পরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মেজরজেনারেল হন এবং তুরুস্কে রাষ্ট্রদুত থাকা অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। অল্প কয়েকজন কারিগরী ক্ষেত্রে কর্মরত এনসিও ছাড়া এই রেজিমেন্ট এর সকল সৈনিক ছিলেন বাঙ্গালি।

৬ ই সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ সালে রাত ৩;৪৫ এ ভারতিয় ৪ মাউন্টেন ডিভিশনের অধিনে দুই ব্রিগেড ভারতিয় সৈন্য ট্যাংক বাহিনী সহ সিমান্তে পাকিস্তানি সিমান্তরক্ষিদের ঘাঁটি গুলিতে হামলা শুরু করে। একই সাথে ১ম ইষ্টবেঙ্গল সহ অন্যান্য পাকিস্তানি অবস্থানে শুরু হয় প্রচন্ড গোলা বর্ষন। ভারতিয় বাহিনীর লক্ষ ছিল বিআরবি খাল পার হয়ে কসুর শহর দখল করে লাহোরের দিকে এগিয়ে যাওয়া। ১ম ইষ্টবেঙ্গল ছাড়া একটি মাত্র পাকিস্তানি ব্যাটালিয়ন এই রাস্তায় তাদের বাধা দিতে পারত। সিমান্ত দখল করে ভোর পাঁচটার দিকে ভারতিয় বাহিনী বিআরবি খালের পুর্বপাশের ১ম ইষ্টবেঙ্গল এর অবস্থানে হামলা করে। কিন্তু বাংলার বাঘদের পরাজিত করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ভারতিয় বাহিনীর ৫ম গার্ডস রেজিমেন্ট এক স্কোয়াড্রন ট্যাংক সহ আলফা কোম্পানির অবস্থানে আক্রমন চালায় কিন্তু পরাজিত হয়ে পিছনে হটে যায়। এরপর ভারতিয়রা সাঁজোয়া বাহিনী নিয়ে হামলা করে। পাকিস্তানের কাছে এই ট্যাংক প্রতিরোধের অস্ত্র বেশি ছিলনা। কিন্তু বাংলার বীর সৈনিক রা নিজের জীবন তুচ্ছ করে গ্রেনেড ও মাইন নিয়ে চলন্ত ট্যাংক এর উপর ঝাপিয়ে পরে। এই আত্মঘাতি আক্রমনের মুখে ভারতিয় বাহিনী অসংখ্য ট্যাংক হারিয়ে পিছিয়ে যায়। এই সময় ভারতিয় বাহিনী থেকে হাতাহাতি লড়াই করে কেড়ে নেয়া একটি পিটি-৭৬ মডেলের উভচর হালকা ট্যাংক এখনও চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার এ সংরক্ষিত আছে। ৬ ও ৭ই সেেপ্টম্বর ভারতিয় বাহিনী একাধিকবার এভাবে ভারি অস্ত্র এবং বিমানবাহিনীর সহায়তা নিয়ে আক্রমন করলেও প্রত্যেকবারই ১ম ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট এর কঠোর প্রতিরোধের মুখে পরাজিত হয়। সেদিন যদি ১মইষ্ট বেঙ্গল এর সৈনিকেরা নিজের জিবন দিয়ে ভারতিয় আগ্রাসি বাহিনীকে না ঠেকাতো তাহলে সহজেই লাহোরের পতন হতে পারত যা পশ্চিম পাকিস্তানকে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলত। ১ম ইষ্ট বেঙ্গল শুধু লাহোরকেই রক্ষা করেনি। ভারতিয় হামলা ঠেকিয়ে পাল্টা হামলা চালিয়ে ভারতিয় সিমান্তের প্রায় আটমাইল ভিতরে খেমকরন শহরটি দখল করে নেয়। অবশ্য পরবর্তিতে এই শহরের দখল ছেড়ে কেীশলগত কারনে পিছিয়ে আসে ১ম ইষ্টবেঙ্গল। এই বিরত্ব পুর্ন যুদ্ধের জন্য ১ম ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে সর্বাধিক পদক লাভ করে। যার মধ্যে অধিনায়ক কর্নেল হক ও আলফা কোম্পনি অধিনায়ক জিয়াউর রহমান সিতারায়ে জুরায়াত পদক পান। 

১৯৬৫ সনের পাকভারত যুদ্ধের এটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন সাফল্য পাকিস্তানের পক্ষে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন